উচ্চবর্গের অবাধ লুণ্ঠনই শ্রীলংকা-পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করেছে

বণিক বার্তা ডেস্ক

শ্রীলংকা এরই মধ্যে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেইল আউট ঋণের কল্যাণে অল্পের জন্য আপাতত একই পরিণতি এড়িয়েছে পাকিস্তান। পরিস্থিতির জন্য প্রধানত রিজার্ভের ঘাটতি, আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারের অস্থিতিশীলতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবজনিত বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটকে দায়ী করছেন দেশ দুটির নেতারা। যদিও অর্থনীতিবিদদের অনেকেই দায়ী করছেন দেশ দুটির ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য উচ্চবর্গীয় শ্রেণীর (এলিট) মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবনকে।

তাদের ভাষ্যমতে, দুই দেশেই সম্পদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ শাসক ঘনিষ্ঠ এলিটদের কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। দেশ দুটির অর্থনৈতিক নীতিমালা, পদক্ষেপ সংস্কারের মূল লক্ষ্যও হয়ে উঠেছিল এলিটদের সুবিধা দেয়া। শ্রেণীর ব্যক্তিরা আবার একে অন্যকে সুবিধা দিতে গিয়ে এক ধরনের অর্থনৈতিক বলয় বন্দোবস্ত তৈরি করে রেখেছিলেন। বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে অবাধে লুণ্ঠনের সুযোগ পেয়েছেন তারা। বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছেন সামষ্টিক অর্থনীতিকে।

শ্রীলংকায় অতিমাত্রায় ক্ষমতাবান প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল রাজাপাকসে পরিবার। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে পরিবারটির সদস্যরা হয়ে উঠেছিলেন দেশটির অর্থনীতির ভাগ্যনিয়ন্তা। রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যকরী প্রধানের দায়িত্ব ছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয় ছিল রাজাপাকসে ভাইদের দখলে। পরিবারের সদস্য ঘনিষ্ঠদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসিয়েছিলেন তারা। সব মিলিয়ে দেশটির মোট জাতীয় বাজেটের ৭০ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল রাজাপাকসে ভাইদের দখলে।

বলা হয়, রাজাপাকসে ভাইদের কর হ্রাস বা রাতারাতি কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মতো অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে জনতোষণবাদী রাজনীতি সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে আরো উসকে দেয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করেছে। আবার নিজ ক্ষমতাবলয়ের অন্য এলিটদেরও নানাভাবে রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় সম্পদ আহরণের সুযোগ দিয়ে এসেছেন তারা। রাজাপাকসেদের ক্ষমতার মূল ভিত হিসেবে ধরা হতো রাজনৈতিক ব্যবসায়িক এলিটদেরই। তারা নিজেদের মধ্যেই এক ধরনের দরকষাকষিমূলক ব্যবস্থা চালু করেছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রাজাপাকসেদের নেতৃত্বে এলিট গোষ্ঠী সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির সাধারণ মানুষ। 

পাকিস্তানেও ক্ষমতা বা শাসন প্রক্রিয়ায় জনসাধারণ নয়, এলিট গোষ্ঠীবলয়ের সদস্যরাই মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেন। গোষ্ঠীবলয় গড়ে উঠেছে মূলত দেশটির সামরিক বাহিনী, ব্যবসায়িক কনগ্লোমারেট, শিল্পপতি, সামন্ত ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে। অনেকটা গোষ্ঠীবদ্ধভাবেই নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার সুরক্ষা দিয়ে চলেছেন তারা। একে অন্যের সঙ্গে নানা সুযোগ-সুবিধা বিনিময় করেছেন। কথিত রয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে তাদের মধ্যে নানা বিরোধ দৃশ্যমান হলেও প্রকৃতপক্ষে দেশটিতে ক্ষমতার পালাবদলও হয় তাদের নিজস্ব সমঝোতার ভিত্তিতে। সর্বশেষ ইমরান খানের ক্ষমতায় আরোহণ ক্ষমতাচ্যুতিতে বক্তব্যের সপক্ষে আভাসও দেখতে পেয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। দেশটির রিয়েল এস্টেট টাইকুন, সুগার ব্যারন, সামরিক বাহিনীর কিংমেকার এবং ব্যবসায়িক শিল্প এলিটরা প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছেন। সুযোগের বিনিময়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে সমর্থন-সহায়তাও দিচ্ছেন তারা। একই সঙ্গে দলগুলোও এলিট ক্ষমতাবলয়ের স্বার্থ পরিপন্থী কোনো ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কার থেকে নিজেদের বিরত রাখছে। ফলে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, অবাধে সম্পদ আহরণ লুণ্ঠনের সুযোগ পেয়েছে এলিট গোষ্ঠী। নিজেরা ফুলেফেঁপে উঠলেও দিনে দিনে ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর অবস্থায় পতিত হয়েছে পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতি।

কয়েক দশক ধরেই দুই দেশের এলিটদের ক্ষমতাবলয় দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সম্পদ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে বাড়ানো রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তকে রীতিমতো চিরস্থায়ী করে রাখতে চাইছেন তারা। টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্র বা তাদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের ধরনেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুই দেশেই এলিটরা জানেন, রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া তাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। এজন্য যেকোনোভাবে হোক রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের কর্তৃত্বকে বহাল রাখতে চাইছেন তারা।

পাকিস্তানে তিন দশক ধরে এলিট শ্রেণীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। যদিও তাদের উত্থানের প্রাথমিক পর্ব ধরা হয় গত শতকে আইয়ুব খানের শাসনামলকে। ওই সময় পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ২২ পরিবার তাদের ক্ষমতার চূড়ায় উঠে গিয়েছিল। ওই সময় সম্পদের কেন্দ্রীভবন তত্কালীন পাকিস্তানের দুই অংশেই মারাত্মক বৈষম্য অসন্তোষের কারণ হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরেও পাকিস্তানে এলিট কনগ্লোমারেটগুলোর আধিপত্য বহাল থাকে। জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে আরেক দল পাঞ্জাবকেন্দ্রিক মিলিটারি-ব্যবসায়ী-সামন্ত এলিটদের উত্থান ঘটে। যদিও গত তিন দশকেই তারা সবচেয়ে বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভবনের সুযোগ পেয়েছেন বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

দৃশ্যের একটু ভিন্ন চিত্রায়ন দেখা গিয়েছে শ্রীলংকায়। দেশটিতে সামরিক শাসকদের পরিবর্তে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোই এলিটদের উত্থানের পথ তৈরি করে দিয়েছে।

দেউলিয়া হয়ে পড়ার পর শ্রীলংকায় ব্যাপক জনঅসন্তোষ দেখা দিলেও পাকিস্তানে তা সেভাবে দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। ইমরান খানের সমর্থকরা তার ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশটিতে বিক্ষোভ-আন্দোলনের কয়েকটি বড় প্রয়াস নিলেও বর্তমানে আইনি জটিলতায় পড়ে অনেকটাই কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন তিনি। আবার তিনি ক্ষমতায় থাকাকালেও দেশটির এলিটরা চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা তুলে নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। যদিও এসব প্রকল্প, বিশেষ করে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ দেশটির ঋণের বোঝাকে আরো ভারী করে তুলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছে বারবার দ্বারস্থ হতে হয়েছে দেশটিকে।

অন্যদিকে শ্রীলংকা এখন চেয়েও ঋণ পাচ্ছে না। চলমান সংকট কাটাতে এখন পর্যন্ত বেইল আউট ঋণ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি দেশটি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন