এশিয়ার পাঁচ দেশের নতুন জোট গঠন

দেশে ভোজ্যতেলের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে কি?

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্ববাজার থেকে ভোজ্যতেল আমদানির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি এশিয়ার দেশগুলোয়। মূলত খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্যের কারণে এসব দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বেশি। কিন্তু সে তুলনায় উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় সারা বছরই উৎপাদক দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রধান বা বড় আমদানিকারক দেশগুলোতে চাহিদা বাড়লে বাংলাদেশসহ দ্বিতীয় সারির আমদানিকারক দেশগুলোয় ভোজ্যতেলের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশের পাম অয়েল আমদানি নিয়ে গঠিত নতুন জোটের মাধ্যমে ভোজ্যতেল আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগের চেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভোজ্যতেল আমদানি করে চীন। এর পরের অবস্থান বৃহৎ জনসংখ্যার আরেক দেশ ভারতের। পাম অয়েলের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও ভূ-রাজনৈতিক নানা বিষয় কাজ করে, আমদানিকারক বড় দেশগুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রধান উৎপাদক দেশগুলোর সঙ্গে বড় আমদানিকারক দেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে ভুগতে হয়। মূলত চীন ভারতের মধ্যে আমদানি প্রতিযোগিতার কারণে ভোজ্যতেল নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে বছরব্যাপী সংকটের মধ্যে পড়তে হয়।

এমন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই গঠিত হয়েছে নতুন জোট এশিয়ান পাম অয়েল অ্যালায়েন্স (এপিওএ) দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি ভোজ্যতেল আমদানিকারক দেশ প্রথমবারের মতো জোট গঠন করেছে। এর সদস্য হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা নেপাল। নতুন গঠিত জোটের লক্ষ্য হলো আমদানি টেকসই এবং আমদানির ক্ষেত্রে দরকষাকষির সুযোগ সৃষ্টি করা।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এপিওএ সক্রিয় থাকলে রফতানিকারক দেশগুলো চাইলেই পাম অয়েলের ক্ষেত্রে এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। আবার রফতানিতে অনাকাঙ্ক্ষিত শুল্ক বৃদ্ধি, দেশভেদে রফতানি রেশনিং করা, রফতানি বন্ধ করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত এড়াতে নতুন জোট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে ভারত চীনের পাম অয়েল আমদানি এবং দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।

বিষয়ে জানতে চাইলে টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার বণিক বার্তাকে বলেন, পাম অয়েল আমদানি করা দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের জোট গঠনের বিষয়টি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। এখন বিভিন্ন দেশের মতামত নেয়া হচ্ছে। উৎপাদক, রফতানিকারক, আমদানিকারকসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বসে কীভাবে সদস্য দেশগুলোর ভোজ্যতেলের সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। পাম অয়েল অর্থাৎ ভোজ্যতেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হওয়ায় উচ্চ দাম সরবরাহ ব্যবস্থাপনার সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে নতুন জোট ভূমিকা রাখতে পারবে। এক্ষেত্রে সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।

তবে বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখছেন দেশের এক ভোজ্যতেল আমদানিকারক গ্রুপের পরিচালক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ভারত-চীনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাণিজ্য নীতির কারণে পাম অয়েলের আমদানিতে প্রভাব পড়ে। বিশেষত চীনের মাসব্যাপী ছুটি চলাকালে পাম অয়েলের চাহিদা বেড়ে গেলে বিশ্ববাজারে এর প্রভাব পড়ে। রফতানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্য সম্পর্কের কারণে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর বদলে চীনকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়া ছাড়াও সরবরাহ সংকটের কারণে এসব দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও দাম বেড়ে যায়। নতুন জোট সদস্যভুক্ত দেশে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে। তবে এক্ষেত্রে নতুন জোট গঠনের ফলে চীনের প্রতিক্রিয়া বা নীতি কী হবে সেটির ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু।

নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য দীর্ঘদিনের। ভারত প্রধান আমদানিকারক হলেও চীনের প্রভাবের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে রফতানিকারকদের ইচ্ছামাফিক সিদ্ধান্তের কারণে ভুক্তভোগী হয়। নতুন জোট কার্যকর হলে দামের ক্ষেত্রে দরকষাকষির সুযোগ না থাকলেও নীতিসহায়তার ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে বাংলাদেশসহ শতভাগ আমদানিকারক দেশগুলো। তবে সবকিছু নির্ভর করছে নতুন জোটের লক্ষ্য কার্যক্রমের পরিধির ওপর।

এপিওএ জোটের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার (এসইএ) প্রেসিডেন্ট অতুল চতুর্বেদী। তিনি জানিয়েছেন, ভোজ্যতেল হিসেবে পাম অয়েল ব্যবহার করে এমন দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবসায়িক স্বার্থকে নতুন জোটের মাধ্যমে সুরক্ষিত করতে চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি সদস্য দেশগুলোতে পাম অয়েলের ব্যবহার বাড়ানোর জন্যও কাজ করবে এপিওএ। পাম অয়েল যে উচ্চমানসম্পন্নসুলভ স্বাস্থ্যকর ভোজ্যতেল সেটি সাধারণ মানুষের কাছে বেশি বেশি করে প্রচার করা হবে। এর যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি আছে তা খণ্ডনের চেষ্টা করা হবে।

ভারত প্রতি বছর প্রায় কোটি ৩০ লাখ থেকে কোটি ৪০ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করে। প্রায় ৮০ লাখ টন পাম অয়েল আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া থেকে। অন্য তেল যেমন সয়াবিন সূর্যমুখীর তেল আসে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইউক্রেন রাশিয়া থেকে। বাণিজ্যের ভিত্তিতে দেখলে বিশ্বের ৪০ শতাংশ পাম অয়েল ব্যবহূত হয় এশিয়ার দেশগুলোতে। যেখানে ইউরোপের দেশগুলোতে হার মাত্র ১২ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া বিশ্বের মূল পাম অয়েল রফতানিকারক দেশ। এশিয়ায় এর সবচেয়ে বড় বাজার ভারতে। মোট বৈশ্বিক আমদানির ১৫ শতাংশ হয় ভারতে, এর পরই রয়েছে চীন। দেশটি আমদানি করে শতাংশ। এরপর রয়েছে পাকিস্তান বাংলাদেশের নাম। যাদের রফতানির হার যথাক্রমে শতাংশ।

পাম অয়েলের প্রধান রফতানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া। দেশটি বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ রফতানি করে। এছাড়া পাম অয়েলে বিশ্ববাজারে মালয়েশিয়ার শেয়ার ২০ শতাংশ। আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশগুলোর অভ্যন্তরে রফতানিসংক্রান্ত অ্যাসোসিয়েশন থাকলেও আমদানিকারক দেশগুলোর গঠিত জোট ভোজ্যতেলের পারস্পরিক স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে সয়াবিনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর মাধ্যমে উৎপাদন মৌসুমে পাম অয়েলের মজুদ বাড়ানো ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো শতভাগ আমদানিকারক দেশের বাজারকে সহনশীল পর্যায়ে রাখা যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশে মোট ব্যবহূত ভোজ্যতেলের প্রায় ৬৫ শতাংশই পাম অয়েল। পণ্যটির চাহিদার পুরোটাই পূরণ হয় ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া থেকে আমদানির মাধ্যমে। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা হয় বাকি ১৩ শতাংশ। ভোজ্যতেলের স্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজার চলতি বছরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। জুন পর্যন্ত পণ্যটির দাম আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। এর মধ্যে বছরের প্রথমার্ধে ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রফতানি নিষেধাজ্ঞাসহ রফতানিতে অতিরিক্ত শুল্কারোপের ফলে বাংলাদেশে পণ্যটির দাম ২০০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে যায়। বর্তমানে বুকিং কমে দুই বছর আগের অবস্থানে ফিরে এলেও দেশের পাইকারি খুচরা বাজারে পাম অয়েলের দাম ফিরে আসেনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন