জন্মদিন

শেখ হাসিনার কূটনৈতিক নেতৃত্বে সুসংহত অবস্থানে বাংলাদেশ

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলাদেশের শাসনভার নিজের কাঁধে নিয়ে যে শান্তি প্রগতির রাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছেন সামনে।সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়বিশ্বশান্তির পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ নীতিই এখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র। মূলমন্ত্রের ওপর ভর করেই সব বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে দেশ উন্নয়ন সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের সর্বকালের সফল প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তার শাসনামলের প্রতিটি পদে রচিত হচ্ছে সফলতার ইতিহাস। তার দূরদর্শী কূটনৈতিক নেতৃত্বের কারণে শেখ হাসিনা সরকারের বিগত ১৩ বছরে অজস্র কূটনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন দেশ বিশ্বপরিমণ্ডলে গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার শান্তির প্রতীক। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। একসময়ের ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশটি আজ আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণ করছে দেশের পররাষ্ট্রনীতি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমৃদ্ধি অর্জনে সুনির্দিষ্ট ভিশন নির্ধারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত করার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আলোকে কার্যকর যুগোপযোগী সহায়ক নীতি গ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের নীতি বাস্তবমুখী পদক্ষেপগুলো বিদেশী কূটনৈতিক মিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম, সভা সেমিনারে তুলে ধরছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদারের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ১১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫২ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ, রফতানি বিদেশে কর্মসংস্থানের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৫ সালে ছিল দশমিক বিলিয়ন ডলার, এখন তা ৩৭ বিলিয়ন হয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মার্চের অবিসংবাদী ভাষণবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলহিসেবে ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের ইউনেস্কো সদর দপ্তরের মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার ঘোষণার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অব্যাহত ঐকান্তিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বীকৃতি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা আর স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির গৌরবময় অবদান মানব ইতিহাসে চিরস্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নেয় স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বাঙালির অর্জন আজ বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য, যা মানবজাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়; অনুপ্রেরণা, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে।

শেখ হাসিনা সরকারের সফল কূটনৈতিক তত্পরতায় ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থলসীমানা সমুদ্রসীমা শান্তিপূর্ণভাবে নির্ধারিত হয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪-এর প্রটোকল স্বাক্ষর এবং ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তির অনুসমর্থন আমাদের প্র্রধানমন্ত্রীর সুদীর্ঘ প্রচেষ্টারই সুফল। ইন্সট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন এবং লেটার অব মোডালিটিস স্বাক্ষরের মাধ্যমে তত্কালীন ১১১টি ভারতের ছিটমহল বাংলাদেশের এবং আমাদের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে এর আগে নাগরিকত্বহীন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব লাভ করে।

সদর দপ্তরসহ বিদেশের সব মিশনে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন, গণহত্যা কেন্দ্র (জেনোসাইড সেন্টার) স্থাপন, জনকূটনীতির পদক্ষেপগুলো, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপীমুজিব চিরন্তনঅনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয় অবদান, বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার ফর ফরেন পলিসি অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি স্থাপন, বঙ্গবন্ধু লেকচার সিরিজ প্রবর্তন, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমেটিক অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স প্রবর্তন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ প্রবর্তন বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন, বঙ্গবন্ধু-ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড ফর ক্রিয়েটিভ ইকোনমি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে গত ডিসেম্বরে ঢাকায়বিশ্ব শান্তি সম্মেলনআয়োজন, জাতিসংঘ এবং ছয়টি দেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ, একাধিক বিদেশী ভাষায় বঙ্গবন্ধুর লেখাঅসমাপ্ত আত্মজীবনীপ্রকাশ এবং বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জীবন, দর্শন বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে অবদানের ওপরে বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশনা, বিগত কয়েক বছরে শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব নির্দেশনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। নিজস্ব অর্থে ২৭টি মিশনের নিজস্ব অফিস বা রাষ্ট্রদূতের বাড়ি কেনা হয়েছে। এসব উদ্যোগের সমন্বিত প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চেতনার বিস্তার ঘটানোর সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে আরো শক্তভাবে তুলে ধরার পথ সুগম হয়েছে।

পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সবার জন্য সুপেয় নিরাপদ পানি এবং পয়োনিষ্কাশন সুবিধা নিশ্চিতকরণ বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। জলবায়ু পরিবর্তন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিবেচনায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও পানিসম্পদবিষয়ক আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। -সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের আলোচনায় পানিকে অন্যতমমানবাধিকারহিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে মানবজাতির অস্তিত্ব সুরক্ষায় পানির অপরিহার্যতার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের পানিবিষয়কহাই লেভেল প্যানেল অন ওয়াটার’-এর (এইচএলপিডব্লিউ) একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সবার জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিবিড়ভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার।

দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াবের বিশেষ আমন্ত্রণে ২০১৭ সালের ১৭-২০ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ৪৭তম বার্ষিক সভায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো নির্বাচিত সরকারপ্রধান সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হন, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরব মর্যাদার বিষয়। দাভোস আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত এবং শিল্প-কারখানাগুলোয় যথাযথ পরিবেশগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে তার সরকারের আন্তরিকতা গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ওপর আলোকপাত করেন।রূপকল্প ২০২১এবংরূপকল্প ২০৪১সামনে রেখে সরকারেরডিজিটাল বাংলাদেশকর্মসূচির কথাও বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরেন তিনি। বার্ষিক সভা চলাকালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের দ্য ইনক্লুসিভ গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৭- বলা হয়, উন্নয়নশীল ৭৯টি দেশের মধ্যে সুষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ আজ বাংলাদেশকে আরো গভীরভাবে জানার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ভাষায় অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, তার মতবাদ, তার ত্যাগ সংগ্রামের কথা পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের কাছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহুবিধ উদ্যোগের ফলে বঙ্গবন্ধুর জীবন কর্ম, বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ-তিতিক্ষা, বাংলাদেশের নীতি মূল্যবোধ এবং সে সঙ্গে দেশের সর্বকালের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতির ধারাবাহিকতায় স্বাধীন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন কূটনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূল্যবোধসমৃদ্ধ বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণে দ্বিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিবিড়করণসহ দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে বড় পরিবর্তন ঘটেছে। কারণ বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক যে গুরুত্ব, সে গুরুত্বটি বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পেরেছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নতুন ধরনের ভূ-রাজনৈতিক লড়াই বা প্রতিযোগিতা চলছে। সে প্রতিযোগিতার ফলে এবং বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে বাংলাদেশ অঞ্চলে একটি নতুন পরিচিতি লাভ করতে পেরেছে।

শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব সফল কূটনৈতিক তত্পরতার ফলে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়। ঐতিহাসিক নিষ্পত্তিতে বঙ্গোপসাগরে লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরোধ নিরসনে বিরল পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে উপনীত হওয়ার নীতি আন্তর্জাতিক আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত করেছে। রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রাণিজ অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় সম্ভাবনাময় সব সম্পদ আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ২০১৮ সালে ভারত চীনের সঙ্গেব্লু ইকোনমিএবংমেরিটাইম খাতের মানোন্নয়নে সহযোগিতাবিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শী কূটনৈতিক তত্পরতায় ইউরোপ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গতি সঞ্চার হয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে যুক্তরাজ্য সফর করেন। সেখানে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নারীর ক্ষমতায়নে অর্জিত সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বর্তমান সরকার এশীয়, বিশেষত দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক, বিমসটেক, দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝে কার্যকর সংযোজক বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (বিসিআইএম-ইসি), বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) প্রভৃতি আঞ্চলিক/উপ-আঞ্চলিক জোট/ফোরামকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এর আওতায় বাণিজ্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধি, সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদ দমনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে গৃহীত বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপের অন্যতম সফল পদক্ষেপ হচ্ছে ঢাকায় বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশনের (বিমসটেক) স্থায়ী সচিবালয় স্থাপন। বিমসটেক সচিবালয় বাংলাদেশে কোনো আঞ্চলিক সংস্থার প্রথম সদর দপ্তর। ঢাকায় বিমসটেক সচিবালয়ের সফল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য।

করোনাভাইরাসের মহামারীর কালে বঙ্গবন্ধু প্রণীত পররাষ্ট্রনীতির ওপর ভর করেই ভ্যাকসিন কূটনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে বাংলাদেশ। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার দক্ষ কূটনীতির কারণে করোনা মহামারীর দুঃসময়ে বিশ্ব সম্প্রদায় যেভাবে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পাশে, তা অতুলনীয়। বিশ্বের বড় বড় দেশ যেখানে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যায়, সেখানে বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলার পাশাপাশি দ্রুততার সঙ্গে নাগরিকদের জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহের ব্যবস্থা করে। ফলে করোনা মহামারী বাংলাদেশকে ততটা কাবু করতে পারেনি। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় থাকার ফলেই এত দ্রুততার সঙ্গে ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শী, দায়িত্বশীল পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বশান্তি আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে সফল রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূলে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি আরো সুদৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে তার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ভূষিত হয়েছেন অজস্র আন্তর্জাতিক পুরস্কার সম্মাননায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বের ৩০তম ক্ষমতাশালী নারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা সম্পর্কিতভিশনারি অ্যাওয়ার্ডএবং ইউনেস্কোরশান্তি বৃক্ষপুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশকে মর্যাদাপূর্ণউইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড ২০১৫পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০১৬ সালে ইউএন-উইমেন প্রধানমন্ত্রীকেপ্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়নহিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘের একই অধিবেশনে নারী সমাজকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে বিচক্ষণ নেতৃত্বদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম প্রধানমন্ত্রীকেএজেন্ট অব চেঞ্জশীর্ষক সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা এবং ইউএন পিস বিল্ডিং কমিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্বে বিপুলভাবে প্রশংসিত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ধারাবাহিকভাবে সর্বাধিক সৈন্য প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নিজের শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে তারা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনে শুধু মহিলা পুলিশ সদস্য নিয়ে গঠিত একটি সম্পূর্ণ কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী ক্ষমতায়ন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দেশটি।

২০১৫- জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননাচ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থপুরস্কারে ভূষিত করা হয়। একই অধিবেশনে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) প্রধানমন্ত্রীকেআইসিটিজ ইন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ডপ্রদান করে। ২০১৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেআইসিটি ফর ডেভেলপমেন্টপুরস্কারে ভূষিত হন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব আহমেদ ওয়াজেদ। স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা প্রদানে প্রধানমন্ত্রী সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১১- ভূষিত হন। একই বছরে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে বক্তব্য প্রদানকালে গণতন্ত্র সুসংহতকরণ নারীর ক্ষমতায়নে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ডাফিন ইউনিভার্সিটি গোল্ড মেডাল ২০১১- ভূষিত হন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের স্কেলিং আপ নিউট্রিশন (এসইউএন) মুভমেন্টের শীর্ষ সাত নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১২ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের শীর্ষ নেতাদের লিড গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কোঅপারেশনের পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে বর্তমান সরকারের অসামান্য সাফল্যের জন্য অ্যাচিভমেন্ট ইন ফাইটিং পোভার্টি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কারণে ২০১৩ সালে বিশ্ব খাদ্য কৃষি সংস্থার এফএও ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড ২০১১ লাভ করেন। এগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য পুরস্কার সম্মাননা তিনি লাভ করেছেন। ট্রি অব পিস অ্যাওয়ার্ড, কালচারাল ডাইভারসিটি মেডাল ২০১২, গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮, অ্যাওয়ার্ড ফর হিউম্যানিটারিয়ান লিডারশিপ ফ্রম গ্লোবাল হোপ কোয়ালিশন ২০১৮ এবং অনন্য নেতৃত্বের জন্য ২০১৮ সালে ইন্টার প্রেস সার্ভিস থেকে পাওয়া আইপিএস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে বহু গুণ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ ভরসাস্থল। দেশের উন্নয়ন সমৃদ্ধির রূপকার তিনি। তার যোগ্য নেতৃত্বে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজ ধ্রুবতারার মতোই উজ্জ্বল। তার নেতৃত্বেই একদিন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাবে আমাদের প্রিয় দেশটি। ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ৭৬তম জন্মদিন। জন্মদিনে অশেষ শ্রদ্ধা জানাই তাকে।

 

. কে আব্দুল মোমেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন