জলবায়ু পরিবর্তনে আউশে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আরো বাড়ানো হোক

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। একদিকে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসছে। আবার বন্যার প্রকোপ বাড়ছে। এতে কৃষি, বিশেষত ধানের উৎপাদন মারাত্মক বিঘ্নিত হচ্ছে, যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এমন পরিস্থিতিতে আশা দেখাচ্ছে আউশ। কৃষকের আগ্রহও বাড়ছে, সরকারও প্রণোদনা দিচ্ছে। আউশ ধানের উৎপাদন বোরোর তুলনায় কিছুটা কম। তথাপি আউশ ধানকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন। কারণ আউশ ধান চাষের জন্য সেচ দেয়ার প্রয়োজন নেই। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, স্থানীয় জাতের আউশ ধানের জাত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত জাতের চেয়ে বৃষ্টিনির্ভর আবাদে বেশি ফলন দেয়। স্থানীয় আউশ ধানের জাতগুলো ভালোভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে পারে। কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আরো বাড়ানো হোক।

সনাতন কাল থেকে দেশের পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে আমন ধান ছিল প্রধান ফসল। এর পরে ছিল বৃষ্টিনির্ভর আউশ ধান। দেশের উত্তর-পূর্বে হাওরাঞ্চল, মধ্য দক্ষিণের কিছু নিচু জায়গায় সীমিত পরিসরে বোরো ধানের আবাদ ছিল। সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে দেশে ইরি ধানের চাষ শুরু হয়। ইরি- জাতটি ছিল রবি মৌসুমের ধান। শুকনো মাটিতে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সেচ, সার বালাইনাশক দিয়ে ধানের চাষ শুরু হয়। সেচযুক্ত বোরো ধানের উচ্চ ফলনে কৃষক উৎসাহিত হন। আউশ ধানের আবাদ ক্রমে ক্রমে কমতে থাকে। এর পেছনের অন্যতম প্রধান কারণ যখন আউশ ধানের বীজ বপন/রোপণ সময় হয় মার্চ-এপ্রিলে, তখন মাঠজুড়ে বোরো ধান থাকে। কৃষক আউশ ধান চাষের জন্য ঠিক সময় বপন/রোপণের জন্য মুক্ত জমি পাচ্ছেন না। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য থেকে দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে ২০০৮ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৬৪ ফুট গভীরে। পাঁচ বছর পরে তা ৯৭ ফুট গভীরে নেমে এসেছে। স্থানীয় বোরো ধানচাষীদের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৫ বছর আগে পানির স্তর ছিল ৪০ ফুট গভীরে, যা এখন ১৬০ ফুট গভীরে নেমে গিয়েছে।

দেশে আউশের আবাদ মূলত প্রচলিত স্থানীয় জাত দিয়ে করার কারণে উৎপাদনশীলতা বেশ কম বলে অভিযোগ করেন অনেকে। অঞ্চলভিত্তিক আবহাওয়াগত পার্থক্য থাকলেও সে অনুযায়ী জাত আসছে না। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানির অভাবের কারণে বোরো ধানের বেশকিছু এলাকায় আবাদ সম্প্রসারণের সুযোগ কমে এসেছে। তবে দেশের অনেক জেলায়ই স্বল্প ব্যয়ে আউশ ধান সম্প্রসারণের সুযোগ আছে। আউশ চাষে কৃষককে লাভবান করতে উচ্চফলনশীল বীজের সম্প্রসারণ সুষম সার ব্যবহার প্রয়োজন। সেজন্য আউশের বিদেশী জাত নেরিকা ধানে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে, কিন্তু ধান উৎপাদনে তেমন লাভবান হচ্ছেন না কৃষক, ফলে তারা আরো বেশি নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সময়ে তারা অন্যসব অর্থকরী ফসল আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন।

আউশের আবাদ উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির ভারসাম্য ধরে রাখতে আউশ আবাদ বাড়ানো হবে। উচ্চফলনশীল জাতের আউশ ধান আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি করা হবে। তুলনামূলক কম উৎপাদন খরচ এবং সরকারের নানাবিধ ভর্তুকি সহায়তা কার্যক্রম এবং পরিবেশগত বিষয়ের কারণে আউশ আবাদ আবার জনপ্রিয় করাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যতম লক্ষ্য। আউশে সেচ প্রয়োজন হয় না। সারও খুব কম লাগে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কিছু নতুন জাত আবিষ্কার করেছে, যেগুলোর ফলনও নাকি ভালো। সন্দেহ নেই, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চাইলে কৃষকের আউশ উৎপাদন বাড়ানো কঠিন নয়। গত কয়েক বছরে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বর্ষার নমুনা পরিবর্তন হয়েছে। এপ্রিল-মে সময়ে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। আবার সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে কম। কারণে আমন করতে কৃষকের কষ্ট হচ্ছে। যদি বন্যা না হয় তাহলে আবহাওয়ার পরিবর্তন কিন্তু আউশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কারণে বোরোর চেয়ে আউশে কৃষক বেশি লাভবান হতে পারেন।

ফসল উৎপাদনে পানি সেচ বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল বিষয়। মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় ৯৬ শতাংশ এপ্রিল-অক্টোবরে হয়। বাকি সময় প্রায় বৃষ্টিহীন। নভেম্বর-এপ্রিল ছয় মাস বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গায় খরা বিরাজ করে। খরার সময়ই বোরো ধান চাষ হয়। অতএব বোরো ধান সম্পূর্ণ সেচনির্ভর। ভূগর্ভস্থ পানিই সেচের প্রধান উৎস। মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। অব্যাহতভাবে অবস্থা চলতে থাকলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুতরাং সেচনির্ভর বোরো ধানের আবাদ কমিয়ে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ধানের চাষ বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারের উচিত বোরো ধান কমিয়ে বরং আউশের দিকে মনোযোগ দেয়া। আউশ বাড়ালে বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। আর বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীলতা কমালে সেচ, সার কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভালো আউশ হয়। আউশকে উৎসাহ দেয়া উচিত। বর্তমান পরিবেশ বা পরিস্থিতির বিবেচনায় আউশকে ফিরিয়ে আনা জরুরি। আউশের সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে। বীজ, সার কীটনাশক কোম্পানিরই আউশের প্রতি আগ্রহ নেই। সেটা ব্যবসায়িক কারণে হতে পারে। তবে সরকারের উচিত আউশের দিকে মনোযোগ দেয়া। আউশের অনেক জাতের চাল লাল হয়, যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। আউশ উৎপাদন বেড়ে গেলে দামও কমবে। অর্থাৎ পরিবেশ জলবায়ুর কথা বিবেচনায় নিয়ে আউশকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন