জলবায়ু পরিবর্তনে আউশে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের

শাহাদাত বিপ্লব

দেশের মোট ভূমির প্রায় তিন-চতুর্থাংশেই উর্বরতা ঘাটতি। সময়ের সঙ্গে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। মাটিতে ধান চাষ করতে গেলে ব্যবহার করতে হয় অতিরিক্ত সার, দিতে হয় সেচ। কীটনাশকের খরচটাও কম নয়। দেশে সবচেয়ে বেশি বোরো ধান চাষ হয়। সেচ সারনির্ভর হওয়ায় মৌসুমে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। আর কীটনাশক ব্যবহার যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে, তেমনি এর প্রভাবে একে একে বিলুপ্ত হচ্ছে উপকারী পোকামাকড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ। অথচ আউশ ধান চাষে নামমাত্র খরচ। তবে বোরোর মতো উচ্চফলনশীল না হলেও জৈব সারনির্ভর ফসল জমিকে উর্বর করতে বেশ ভূমিকা রাখে। তখন আমন মৌসুমে উৎপাদন বাড়ে অনেক বেশি।

গ্রামবাংলায় একসময় আমন আউশ দুই মৌসুমেই ধান চাষ হতো। যদিও আউশের ফসল ঘরে তোলা নিয়ে সবসময়ই শঙ্কায় থাকতেন কৃষক। বন্যার কারণে প্রায় বছরই তলিয়ে যেত সোনালি ধান। এদিকে শুষ্ক অর্থাৎ একই মৌসুমে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি উচ্চফলনশীল জাত চলে আসায় কৃষক ধীরে ধীরে আউশ আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তবে সম্প্রতি বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কমেছে বৃষ্টি। নদী অববাহিকা এলাকা ছাড়া দেশে এখন আর তেমন বন্যা হতেও দেখা যায় না। পাশাপাশি সেচ খরচ সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারো আউশ ধান চাষের প্রতি ঝুঁকছেন কৃষক। মাটির গুণাগুণ ঠিক রাখতে উচ্চফলনশীলের পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে উপযোগী শস্য আবাদে বিশেষজ্ঞরাও পরামর্শ দিচ্ছেন। এজন্য আউশ আবাদ হতে পারে সবচেয়ে উপযোগী।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে। এরই মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ ফসল কাটা হয়েছে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন হয়েছে দশমিক ৮১ টন। যদিও রাজশাহী অঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবার হেক্টরপ্রতি আউশের ফলন হয়েছে তিন টনেরও বেশি। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ নাটোর জেলায় মোট লাখ ৫১ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পর্যন্ত মোট ৮৪ শতাংশ ফসল কাটা হয়েছে। ফলনের হার হেক্টরপ্রতি দশমিক ১৬ টন। এর মধ্যে নওগাঁ জেলায় চলতি বছর ৫৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আউশ ধান আবাদ করা হয়েছে। চাল উৎপাদন করা হয়েছে লাখ ৬২ হাজার টন। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে মহাদেবপুর উপজেলায়। সেখানে ফলনের হার ছিল হেক্টরপ্রতি প্রায় দশমিক ১৩ টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বছর ৪২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আউশ ধান আবাদ করা হয়েছে। গড় ফলন হয়েছে দশমিক ২০ টন। রাজশাহী জেলায় ৪৩ হাজার ১০৩ হেক্টর জমিতে গড় ফলন হয়েছে দশমিক ২৭ টন। আর নাটোরে ১০ হাজার ৭৫ হেক্টর জমিতে গড় ফলন হয়েছে দশমিক ২৯ টন।

প্রায় একই চিত্র আউশ আবাদ করা অন্যান্য অঞ্চলেও। কুষ্টিয়া জেলায় বছর ২৮ হাজার ১৩৭ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে গড় ফলন হয়েছে প্রায় দশমিক ১৫ টন। কুমিল্লা জেলায় ৭৮ হাজার ৫৬৪ হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন হয়েছে লাখ ৩৫ হাজার ২২৮ টন। সে হিসাবে গড়ে প্রতি হেক্টরে প্রায় তিন টন ফলন হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ুর অভিঘাতে বর্ষা মৌসুম পরিবর্তন হওয়ায় কৃষকরা তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারছেন। এছাড়া নতুন কিছু উচ্চফলনশীল জাত চাষে আউশ মৌসুমে ফলনের হার বাড়ছে। ফলে প্রতি বিঘা জমিতে কৃষকরা ১৮-২২ মণ পর্যন্ত ফলন পাচ্ছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক . পলাশ সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আউশের ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি দশমিক শূন্য টন। বছর তা দশমিক ১৯ টন হয়েছে। আগামীতে আউশের ফলন আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়। উচ্চফলনশীল জাতগুলো চাষের কারণেই কৃষকরা ভালো ফলন পাচ্ছেন।

রাজশাহী বিভাগের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মনিটরিং মূল্যায়ন কর্মকর্তা মো. আহসান হাবীব খাঁ বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক জায়গায় আউশ মৌসুমে বন্যা হওয়ার কারণে ফসল ডুবে যায়। ফলে ভালো ফলন পাওয়া যায় না। তবে এলাকায় বন্যা না থাকায় কৃষকরা প্রতি বিঘায় পান ১৮-২২ মণ। তাছাড়া আউশ চাষের জন্য সরকারি বীজ বা সার প্রণোদনা দেয়া হয়। সেচ কম দিতে হয়। আবার সারও কম লাগে। আগে আউশ ধানের খড় নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু এখন খড় পাওয়া যাচ্ছে। দামও বেশি। ফলে আউশ চাষে কৃষক এখন উৎসাহিত হচ্ছেন।

কৃষকরা জানান, বোরো মৌসুমের চেয়ে আউশে ফলন কম হলেও সেচ সার অনেক কম লাগে। বোরোতে সেখানে দুই-তিন গুণ বেশি সার প্রয়োজন হয়। সেচ প্রয়োজন হয় কয়েক গুণ বেশি। নওগাঁ সদর উপজেলার বাঁচারি গ্রামের কৃষক আহসান হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, আমি এবার একটু দেরি করেই আউশ চাষ করেছি। ১০ বিঘা জমিতে ভালো ফলন হয়েছে। আশা রাখছি এবার বিঘাপ্রতি ১৮-২০ মণ পাব। গত বছর ১৬ মণ পেয়েছিলাম। আশপাশের কৃষকরা এবার বিঘাপ্রতি ১৮-২০ মণ ধান পেয়েছেন, যা অন্যান্যবারের চেয়ে ভালো। বর্ষা বেশি হলে আউশ ধানের ক্ষতি হয়। ধান শুয়ে পড়ে, গাছ পচে যায়। কিন্তু এবার বর্ষা কম ছিল। আউশ মৌসুমের জন্য একেবারে অনুকূল পরিবেশ। আউশে সার অনেক কমে লাগে। এক বিঘা জমিতে ১৫ কেজি ইউরিয়া, ডিএপি ২০ কেজি পটাশ ১০ কেজি প্রয়োজন হয়। বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘায় ৩০ কেজি ইউরিয়া, ২৫-৩০ কেজি ডিএপি পটাশ ১৫-২০ কেজি লাগে।

একই জেলার আরেক কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, এবার আউশ মৌসুমে আমার বোরোর চেয়েও ফলন ভালো হয়েছে। সপ্তাহেই ধান কাটব। পাঁচ বিঘা জমিতে চাষ করে আশা করছি বিঘাপ্রতি ২২-২৫ মণ ধান পাওয়া যাবে। আউশে সার খুবই কম লাগে। ধান চাষ করার পর উপরি প্রয়োগে এক বিঘায় ১০ কেজি পটাশ, ১০ কেজি ডিএপি আর পাঁচ কেজি ইউরিয়া দিয়েছি। সেচ দিয়েছি তিনটি। প্রতি বিঘায় ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা খরচ হয়েছে। বোরো মৌসুমে সেচের ওপরই ধান হয়। আড়াই বিঘা জমিতে ৫২ মণ ধান পেয়েছিলাম। একজনের সঙ্গে সেচের বিষয়ে চুক্তি করায় চার ভাগের এক ভাগ ধান তাকে দিতে হয়েছে। অর্থাৎ ১৩ মণ ধান সেচের বিনিময়ে দিয়েছি। টাকার অংকে হিসাব করলে প্রতি মণ হাজার ১০০ হারে প্রায় ১৪ হাজার ৩০০ টাকা হয়। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় প্রায় সাড়ে থেকে হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার কৃষক গণেশ চন্দ্র জানান, আড়াই বিঘা জমিতে আউশ মৌসুমে চাষ করেছেন তিনি। দেশীয় জাত চাষ করে বিঘাপ্রতি ১৮ মণের বেশি ধান পাওয়া গিয়েছে। আগের বছর ১৪ মণ পেয়েছিলেন। এর আগেও রকমই পেতেন। তবে বর্ষা বেশি হলে ফলন কমে যায়। এবার বর্ষা না থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। জমিতে মোট ১০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করেছিলেন, যেখানে বোরো মৌসুমে ২৫-৩০ কেজি ইউরিয়া দিতে হয়। অন্যান্য সারও দ্বিগুণের বেশি দিতে হয়। যে জমিতে আউশে দুটি সেচ লাগে, সেই জমিতে বোরো মৌসুুমে ২০-২২টি সেচ প্রয়োজন হয়। তবে বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘায় ৩০ মণ পর্যন্ত পেয়েছেন। বোরোতে খরচও বেশি, উৎপাদনও বেশি।

মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বর্তমানে দেশে উর্বরতা বা পুষ্টি ঘাটতিযুক্ত ভূমির পরিমাণ কোটি ১১ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ। ফলে শস্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করতে হয়। ফলে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে দূষণ হচ্ছে পরিবেশও। আউশ মৌসুমে সারের কম প্রয়োজন হওয়ায় এর চাষাবাদ সম্প্রসারণে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বণিক বার্তাকে বলেন, আউশে কৃষকদের আগ্রহ ছিল না, তা কিন্তু নয়। বোরো ধানের কারণে আসলে আউশ করা যায় না। কারণ বোরো ধান চাষাবাদের সময় আর আউশের সময় প্রায় এক। কৃষকরা একসময় আউশের বীজও হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিছু আউশের জাত খরা বা অন্যান্য সমস্যা সহনশীল, যেগুলোর ফলনও ভালো হয়। আবার সার, কীটনাশক তেমন লাগে না। খরাসহিষ্ণু হওয়ায় সেচ লাগে না। সরকারের উচিত বোরো ধান কমিয়ে বরং আউশের দিকে মনোযোগ দেয়া। আউশ বাড়ালে বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। আর বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীলতা কমালে সেচ, সার কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। আমাদের দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভালো আউশ হয়। আউশকে উৎসাহ দেয়া উচিত। বর্তমান পরিবেশ বা পরিস্থিতির বিবেচনায় আউশকে ফিরিয়ে আনা জরুরি। আউশের সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে। বীজ, সার কীটনাশক কোম্পানিরই আউশের প্রতি আগ্রহ নেই। সেটা ব্যবসায়িক কারণে হতে পারে। তবে সরকারের উচিত আউশের দিকে মনোযোগ দেয়া। আউশের অনেকগুলো জাতের চাল লাল হয়, যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। আউশ উৎপাদন বেড়ে গেলে দামও কমবে। অর্থাৎ পরিবেশ জলবায়ুর কথা বিবেচনায় নিয়ে আউশকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক . মোহাম্মদ হাম্মাদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আশির দশকের আগে আউশের চাষ বেশি ছিল। কিন্তু যখন সেচ এল তখন বোরো মৌসুমে চাষ বাড়তে থাকল। কৃষকও বোরোতে বিনিয়োগ বাড়াতে লাগলেন। ফলে আউশের চাষ কমে যায়। এখন বেশকিছু জায়গায় আগাম বোরো করছেন। ফলে আবার আউশের একটা বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে দেখেছি আউশ চাষে কৃষক ভালো ফলন পেয়েছেন। সরকার যদি মনে করে চালের যে ঘাটতি আছে তা পূরণ করার, তাহলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চাইলে কৃষকরা আউশ উৎপাদন বাড়াতে পারবেন। গত কয়েক বছরে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বর্ষার নমুনা পরিবর্তন হয়েছে। এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। আবার সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে কম। কারণে আমন করতে কৃষকদের কষ্ট হচ্ছে। যদি বন্যা না হয় তাহলে আবহাওয়ার পরিবর্তন কিন্তু আউশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কারণে বোরোর চেয়ে আউশে কৃষক বেশি লাভবান হতে পারেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আউশকে আমরা এখন উৎসাহ দিচ্ছি। কারণ আউশে সেচ প্রয়োজন হয় না। সারও খুব কম লাগে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কিছু নতুন জাত আবিষ্কার করেছে, যেগুলোর ফলন ভালো। প্রতি বছর আমরা আউশ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রণোদনা দিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করছি। ফলে কৃষকও ভালো ফলন পাচ্ছেন। আমাদের যেহেতু খাদ্যোৎপাদন বাড়াতে হবে, সে কারণে আমরাও আউশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন