শাহজালাল ব্যাংককে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছি

এম শহীদুল ইসলাম প্রায় চার বছর দায়িত্ব পালন করছেন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে। চাকরির বয়সসীমা ৬৫ পূর্ণ হওয়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ ৩৮ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের নানা বাঁকবদল নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

৩৮ বছর ধরে ব্যাংকিং পেশায় আছেন। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যাচ্ছেন। দীর্ঘ কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়ালেখা শেষে চাকরি খুঁজছিলাম। পেশা হিসেবে পছন্দের শীর্ষে ছিল ব্যাংকিং। সেটি আজ থেকে প্রায় চার দশক আগের কথা। সে সময় ব্যাংকিং পেশার অন্য রকম সম্মান মর্যাদা ছিল। বেতন-ভাতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেও ব্যাংকে চাকরি ছিল আকর্ষণীয়। তখন দেশে ব্যাংক ব্যাংকারের সংখ্যাও ছিল খুবই কম। বেসরকারি খাতে ব্যাংকের সূচনা হয়েছিল মাত্র। ১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করি। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সময় বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থা খুবই ভালো ছিল। দক্ষ ব্যাংকার তৈরিতে ব্যাংকটির ভূমিকা ছিল অসামান্য। ১৪ বছর ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরি করেছি। ১৯৯৭ সালে যোগ দিই প্রাইম ব্যাংকে। ব্যাংকেও ছিলাম ১১ বছর। ২০০৮ সালে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে কাজ শুরু করি। ২০১৭ সালে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিই শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ব্যাংকের এমডি শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে দায়িত্ব পালন করছি।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে করপোরেট ক্রেডিট, এসএমই ক্রেডিট, বৈদেশিক বাণিজ্য, কনজিউমার ব্যাংকিং, ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, সিন্ডিকেটেড ফাইন্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ, ট্রেজারিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেছি। চাকরি জীবনের দীর্ঘ একটি সময় ব্যাংকের শাখায় কাজ করেছি। কারণে দেশের বেশির ভাগ বড় মাঝারি ব্যবসায়ী ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চেনেন। তাদের সবার সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সততা নীতিনৈতিকতার প্রশ্নে কখনো আপস করিনি। ব্যাংকিং পেশার ৩৮ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোনো ব্যাংকার সৎ থাকতে চাইলে তাকে অসৎ হতে বাধ্য করা সম্ভব নয়।

শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংককে কোথায় রেখে যাচ্ছেন?

আমি শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব গ্রহণের আগেও এটি ভালো ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত ছিল। তবে কিছু মৌলিক সংকটের কারণে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারছিল না। ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহ ব্যয় আয়-ব্যয় অনুপাত ছিল অনেক বেশি। বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপ্তি ছিল অনেক কম। ফলে ভালো অবস্থানে থেকেও প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জিত হচ্ছিল না। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সবার আগে তহবিল সংগ্রহ ব্যয় কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিই। এজন্য উচ্চ ব্যয়ের আমানত ছেড়ে দিয়ে কম ব্যয়ের আমানত সংগ্রহে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করি। ওই বছর আমরা হাজার কোটি টাকার স্বল্প ব্যয়ের আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম। কিন্তু বছর শেষে আমরা হাজার কোটি টাকার আমানত পাই। এরপর প্রতি বছরই আমরা উচ্চ ব্যয়ের আমানত কমিয়ে স্বল্প ব্যয়ের আমানত সংগ্রহে বিশেষ ক্যাম্পেইন চালিয়েছি। প্রতিটি ক্যাম্পেইনই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সফল হয়েছে। ব্যাংকের সব কর্মী এক্ষেত্রে উজ্জীবিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কর্মীদের মনে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে আমরা চাইলে পারি। কারণে মাত্র তিন বছরে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের তহবিল ব্যয় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ব্যাংকের সবকটি সূচকে পড়েছে।

চার বছর আগে দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর জন্য অন্য ব্যাংক থেকে আমানত ধার করতে হতো। এখন শাহজালাল ব্যাংকই দেশের অন্য ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত ধার দিচ্ছে। একটি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে যে কয়টি উপাদন প্রয়োজন, শাহজালাল তার সবকটি অর্জন করেছে। ব্যাংকের ভিত এখন অনেক বেশি মজবুত টেকসই। যেকোনো ঝড় মোকাবেলার সক্ষমতা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে।

ব্যাংকটির মৌলিক সূচকগুলোর উন্নতি সম্পর্কে জানতে চাই?

২০১৮ সালের জুনে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কস্ট অব ডিপোজিট বা আমানত সংগ্রহ ব্যয় ছিল দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি বছরের জুনে ব্যয় দশমিক ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। চার বছর আগে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বা তহবিল সংগ্রহ ব্যয় ছিল দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি বছরের জুনে ব্যয় নেমে এসেছে দশমিক ৯৪ শতাংশে। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন তহবিল ব্যয়ে শাহজালালের অবস্থান এখন শীর্ষস্থানীয়। ২০১৮ সালে ব্যাংকের হাই কস্ট ডিপোজিট ছিল ৬৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বর্তমানে তা ৫৫ দশমিক ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে। সে সময় ব্যাংকটির নো কস্ট ডিপোজিট ছিল ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ, এখন সেটি বেড়ে ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালের জুনে ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের অনুপাত ছিল ৪৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। চলতি বছরের জুনে ব্যয় মাত্র ৩৪ দশমিক ২৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

গত চার বছরে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালের জুনে ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে খাতের বাণিজ্য ২৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৭৭১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হাজার ৮১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তহবিল ব্যয় প্রায় অর্ধেক কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ায় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দেড় গুণ বেড়েছে। ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ২১০ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) ৪৯৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জিত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ১৩৬ শতাংশেরও বেশি। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এখন ৩৫ হাজার ২২০ কোটি টাকার ব্যাংক।

নতুন প্রজন্মের ব্যাংকারদের জন্য কী উপদেশ দিতে চান?

ব্যাংকারদের কাছে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রতিটি সংবাদ সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য থাকতে হবে। তাহলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে। অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষমতাও ব্যাংকারদের থাকা দরকার।

একটি ব্যাংক সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আদর্শ পরিচালনা পর্ষদ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আদর্শ পরিচালনা পর্ষদ সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। পরিচালনা পর্ষদের ওপরও নানা ধরনের অনৈতিক চাপ থাকে। আবার পরিচালকদের অনেক ক্ষমতা রয়েছে, এটিও সত্য। তবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নীতির প্রশ্নে আপসহীন হলে পরিচালকরা কোনো অনৈতিক সুবিধা চাইতে দ্বিধায় থাকেন। ব্যাংকাররা নিজেই যদি অনৈতিক সুবিধা ভোগ করেন, তাহলে পরিচালকরা চেপে ধরেন। ব্যাংকারদের আইন, নীতি নৈতিকতা সব মেনে চলতে হবে। চাকরি জীবনে চারটি ব্যাংকের পর্ষদের সঙ্গে কাজ করেছি। হাসিমুখে অনেক প্রভাবশালী পরিচালক চেয়ারম্যানকে না বলেছি। অনেকেই সংক্ষুব্ধও হয়েছেন। কিন্তু দিন শেষে সত্যেরই জয় হয়েছে।

আমার সৌভাগ্য হলো, এমডি হিসেবে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে একটি আদর্শ পরিচালনা পর্ষদ পেয়েছিলাম। এখানে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছি। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে ব্যাংক উপকৃত হয়েছে।

চলতি মাসেই ব্যাংকিং ক্যারিয়ার থেকে অবসরে যাচ্ছেন। অবসর জীবনে কী করবেন?

পড়ালেখা আর চাকরিতে জীবনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় হয়ে গিয়েছে। এজন্য অবসর উপভোগ করতে চাই। পৃথিবীর সব প্রান্ত ঘুরে দেখার ইচ্ছা আছে। নতুন কিছু করতে চাইলে সেটির জন্য সময় নেব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন