বিশ্ব পর্যটন দিবস

সংকট উত্তরণে পর্যটনে নতুন ভাবনা

ড. সন্তোষ কুমার দেব

পর্যটন এখন শুধু কোনো ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দেশ ভ্রমণ নয়, বরং সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য একটি বিশ্বজনীন। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনের রূপ, প্রকৃতি এবং সেবার মানে এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। শুধু তাই নয়, বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে টিকে থাকার জন্য পর্যটন শিল্পের ভূমিকা অতুলনীয় কিন্তু কভিড-১৯ মহামারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কভিড-১৯ মহামারীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরগুলোর মধ্যে পর্যটন সেক্টর অন্যতম।

বিশ্বব্যাপী ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘের অধীন বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে সব সদস্য দেশে এটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে সেতুবন্ধ গড়ে তোলা। এছাড়াও পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া দিবসের অন্যতম লক্ষ্য। গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক আলোচনায় দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ধারণাটি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। কারণ, এটি ছাড়া কোনো দেশই তাত্পর্য আয় প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাস করতে সক্ষম হয়নি। বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির মূল কথা।

২০১৯ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পর্যটন, ২০২০ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল পর্যটন গ্রামীণ উন্নয়ন, ২০২১ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন এবং ২০২২ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে Rethinking Tourism বছর ২০২২ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য Rethinking Tourism এবং বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপনের জন্য বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ইন্দোনেশিয়াকে অফিশিয়াল আয়োজনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করেছেন এবং ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত হবে। বছর বিশ্ব পর্যটন দিবসের মূল ফোকাস হলো কীভাবে অধিকতর টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন শিল্পে করোনা ভাইরাস সংকট-পরবর্তী অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণে সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ, কর্মসম্পাদনের গাইড লাইন প্রস্তুতকরণ। পর্যটন শিল্পে সংকট উত্তরণে বিকল্প কর্মপন্থা নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে পর্যটনসংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মনে আস্থা তৈরি করে, তাদের উদ্দীপিত করে নিউ নরমাল আবহে খাপ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

কভিড-১৯- সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন শিল্প। কভিড-১৯ মহামারীর সংকট কাটিয়ে অর্থনীতিকে পুনর্জীবিত কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য যে পাঁচটি সেক্টরকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এর মধ্যে পর্যটন উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নে অন্যতম ভূমিকা রাখবে পর্যটন শিল্প। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন, সমবায় পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, সুনীল পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম ভার্চুয়াল ট্যুরিজম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।         

উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশেই পর্যটন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ধনাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান। পর্যটন শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং ধনী-দারিদ্র্য বৈষম্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণেরে মধ্য দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। তাছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে নৃতাত্ত্বিক গ্রামভিত্তিক পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড পর্যটনদায়িত্বশীল পর্যটন, টেকসই পর্যটন, কৃষি পর্যটন, প্রো-পোর পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন বিকাশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, সামাজিক খাত উন্নয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস, পরিবেশ রক্ষা এবং আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা সম্ভব। তাছাড়া নানাবিধ পর্যটন কার্যক্রমে এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।

টেকসই পর্যটন বিনির্মানে মহামারী সংকট উত্তরণে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম, রিভার ট্যুরিজম, হাওর ট্যুরিজম, গ্রামীণ পর্যটন সুনীল পর্যটনের গুরুত্বারোপ করতে হবে। বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের উপাদানগুলোর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ওয়েবসাইট, বিগ ডাটা কনটেন্ট মার্কেটিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় পর্যটন ব্র্যান্ডিং প্রমোশনের ক্ষেত্রে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ানর্থ আমেরিকা এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব) ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করছে, অতএব উন্নত বিশ্বের মতো পর্যটন প্রমোশনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের ওপর দেশে গুরুত্বারোপ করতে হবে। পর্যটনের নতুন ধারণার PPCP (Private-Public-Community Partnership) ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। ছোট ছোট প্রমো তৈরি করে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্র্যান্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটন।

তবে সম্প্রতি করোনা ভাইরাস পর্যটন শিল্পকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বিধায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডাররা। এমনকি ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষের আয়ের ওপর এবং চাকরি হারিয়েছে অনেক লোক। বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানমুখী। বাংলাদেশে পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, মিঠামইন হাওর, সিলেটের চা-বাগান, রাতারগুল, বিছানাকান্দি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটিই দেখা যায়। কোরাল আইল্যান্ড সেন্টমার্টিন, রামুর বৌদ্ধমন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ইনানী সমুদ্রসৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি অঞ্চল দেখে পর্যটকরা আত্মভোলা হয়ে যান। আবার আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী শুধু দেশী বিদেশী পর্যটক এবং দর্শনার্থীর কাছেও সমান জনপ্রিয় সমাদৃত।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি-২০৩০) অর্জন ত্বরান্বিত করতে সমবায়ভিত্তিক পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম, জেলাভিত্তিক পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন হাওর পর্যটন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একতা-সাম্য সহযোগিতার প্রত্যয় বৃদ্ধি করে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে পর্যটন শিল্প বাংলাদেশে জাতীয় উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য পর্যটন প্রসার প্রয়োজন। অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে সমবায় পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড পর্যটন আরো সম্প্রসারিত হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, একতা, সাম্য বৃদ্ধি পাবে, যা বর্তমানে চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সহযোগিতা করবে এবং বাস্তবায়িত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।

পর্যটকের কাছে পুনঃআস্থা তৈরি নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টির লক্ষ্যে রিকভারি প্ল্যান বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো চিহ্নিতকরণ, প্রচার প্রসারের কাজ গবেষণার পরিধি বৃদ্ধি করে পর্যটক প্রত্যাশা সম্পর্কে ধারণা সমৃদ্ধ করা দরকার। সেই সঙ্গে ডিজিটাল সেবা ডিজিটাল মার্কেটিং কৌশলগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে দেশীয় আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ সন্তুষ্টিবিধান আরো সহজ হবে।

 

. সন্তোষ কুমার দেব: অধ্যাপক চেয়ারম্যান

ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন