প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১০ বছরে বাস্তুচ্যুত ১ কোটি ১৪ লাখের বেশি বাংলাদেশী

অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনায় জাতীয় কৌশলপত্রের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হোক

জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর গড়ে ১১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এখন ধরনের দুর্যোগের মাত্রা ভয়াবহতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিকে দুর্যোগজনিত মোট অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘটছে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায়। এদিক থেকে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে জলোচ্ছ্বাস ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকাগুলোর একটি হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট দুর্যোগগুলোর পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিও এখন বাংলাদেশকে অনেক নাজুক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। জলোচ্ছ্বাস ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে অতিবৃষ্টি, তীব্র বায়ুপ্রবাহ এবং ঝড়ের কারণে অভিঘাত এলাকার প্রচুর ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাসস্থান টিকে থাকার সরঞ্জাম হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে অনেকেই। সতর্কতামূলক পদক্ষেপে প্রাণহানি কমলেও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জীবিকার সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্যোগের পর উপদ্রুত এলাকা বসবাস আবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরমুখী হচ্ছে জীবিকার তাগিদে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় মানুষকে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি মানুষকে দুর্যোগ মোকাবেলার কৌশল শেখাতে হবে। তবে মানুষ কম শহরমুখী হবে। এক্ষেত্রে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে তদারকি জোরদার করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর যে অধিকারহীনতা তৈরি হয়, তার নিশ্চয়তা বিধান করাই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনার মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত। কারণ অধিকারহীনতাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরো বেশি প্রান্তিক করে তোলে। শুধু দুর্যোগের মধ্যে টিকে থাকা নয়, ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আবাসন, কর্মসংস্থান কৃষি, সুপেয় পানি ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এখানেই ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী না হলেও এরাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। উপকূলীয় এলাকার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ঠাঁই নিচ্ছে শহরগুলোর বস্তিতে, বিশেষ করে ঢাকার বস্তিগুলোতে। এর ফলে দ্রুত বর্ধনশীল বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির শহর ঢাকা দিন দিন আরো ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠছে। মনে করা হয়, ঢাকা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। সে কারণে, সারা দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ ছুটে আসছে ঢাকায়। আশ্রয় নিচ্ছে বস্তিতে। কিন্তু ঢাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ চরম গরিব। এখানে সমস্যার শেষ নেই। এর পরও প্রতি বছর নানা কারণে বসতভিটা ছেড়ে ঢাকায় আসছে স্বল্প আয়ের মানুষ। ফলে পরিবেশবিদদের কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা সিটি এখন পরিণত হয়েছে জলবায়ু শরণার্থীর বস্তিতে। কিন্তু ঢাকায় এসে তাদের প্রথমেই হোঁচট খেতে হয় কর্মসংস্থান নিয়ে। তবু জলবায়ু শরণার্থীরা ঢাকামুখী। এসব জলবায়ু শরণার্থীদের ঢাকামুখী হওয়া ফেরাতে না পারলে ঢাকার পরিস্থিতিও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আন্দাজ করতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে নানা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। আমরা জলবায়ু সংকটের প্রভাব অবলোকন করেছি নিকট অতীতেও। গত গ্রীষ্মে আমেরিকার দাবানলে এবং ২০২০ সালে মেগাস্টর্মে। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, হয়তো সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন সমুদ্রের পানির উচ্চতা ২০ ফুট ( মিটার) উপরে উঠে আসবে। তখন মালদ্বীপের মতো অনেক দেশ পুরোপুরি তলিয়ে যাবে পানির নিচে। আমাদের উপকূল অঞ্চল তখন বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই হওয়া উচিত আমাদের ভাবার বিষয়। দুর্যোগ প্রশমন বলতে দুর্যোগ পূর্বপ্রস্তুতি ক্ষয়ক্ষতির হ্রাস করাকে বোঝায়। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ দুর্যোগের সঠিক পূর্বাভাস প্রদানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। নদীতীরে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৫, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১৫, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১১এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে জলবায়ুগত পার্থক্য বিবেচনায় ১১টি অঞ্চলে বিভক্ত এবং ১৪টি বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুনাম সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা আর দুর্যোগ মোকাবেলা করে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে কিছু সক্ষমতা সামর্থ্যগত পার্থক্য আছে। দুর্যোগ মোকাবেলা করে বেঁচে থাকাই যথেষ্ট না, বরং প্রশ্ন হচ্ছে দুর্যোগ মোকাবেলা করে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা যাচ্ছে কিনা; যেখানে জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় রসদ, সেবা এর কার্যকর ব্যবস্থাপনাই মুখ্য। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দুর্যোগ এবং জলবায়ুতাড়িত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় কৌশলপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে। কৌশলপত্রটির মূল লক্ষ্য হলো দুর্যোগ-পূর্ববর্তী সময়ে বাস্তুচ্যুতি প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ চলাকালীন অবস্থায় দুর্যোগকালীন বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা এবং পরবর্তী সময়ে বাস্তুচ্যুত-পরবর্তী সম্ভাব্য স্থায়ী সমাধানগুলো উপস্থাপন করা। এরই ধারাবাহিকতায় বলা যায়, কৌশলপত্রটির দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প হলো দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা জনগোষ্ঠীকে পরিবর্তনশীল জলবায়ু দুর্যোগের প্রতি সহিষ্ণু বা অভিঘাত-সক্ষম করে তোলা। এর লক্ষ্য হলো সামগ্রিক অধিকারভিত্তিক বাস্তাবায়নযোগ্য টেকসই কাঠামো গড়ে তোলা যা বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্যোগ জলবায়ুজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার মানুষকে শ্রদ্ধা করবে, সুরক্ষা দেবে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করবে। এর বাস্তবায়নে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে এবং সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়তে পারে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের সুরক্ষা অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, নিয়ে সরকারের কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। আমরা জানি, বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা আছে এবং সে পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনাও করছে। তবে তাদের কর্মকাণ্ড যে পর্যাপ্ত নয় তা ৬৮ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। ফাঁক চিহ্নিত করতে হবে। ফাঁক বন্ধ করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে বিষয়টির মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখা জরুরি, সমস্যা অস্থায়ী কোনো সমস্যা নয়। সমস্যাটি স্থায়ী এবং আমাদের জীবনের একটি অংশ হিসেবেই বিবেচিত। দুর্যোগকে যখন বাংলাদেশের মানুষকে মেনে নিতে হচ্ছে, তখন পরিত্যাগের কথা না ভেবে সহাবস্থানের কথা চিন্তা করাটাই শ্রেয়। আর সে কারণেই বাস্তুচ্যুত মানুষের দিকে সরকারের দৃষ্টি দেয়া দরকার। বাংলাদেশের বাস্তুচ্যুত মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বাস্তুচ্যুত মানুষের আইনি সুরক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে একটি আলাদা আইন প্রণয়ন করতে হবে। দেশের জনগণ সংবিধানে যেসব অধিকার ভোগ করে, বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকেও একই ধরনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ তাদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন