সার্জনের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে

অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের শিশু হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শিশুদের হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে কাজ করছেন। চিকিৎসা করেছেন শিশুদের জটিল হৃদরোগের। জন্মগতভাবে শিশুদের হৃদযন্ত্রের পর্দায় ত্রুটি বা ছিদ্রের  কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তা সঙ্গে

শিশুদের হৃদযন্ত্রের পর্দায় ছিদ্র শুধু কি জন্মগতভাবেই হয়?

শিশুদের হৃদযন্ত্রের পর্দায় ছিদ্র সাধারণত জন্মগতভাবেই হয়। দুর্ঘটনার কারণে বা আঘাতের ফলেও কখনো ছিদ্রের সৃষ্টি হতে পারে, তবে তা বিরল। জন্মগতভাবে ছিদ্র হওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে পারেননি। তার পরও গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যেসব মায়ের ডায়াবেটিস থাকে তাদের সন্তানের ক্ষেত্রে জন্মগত হৃদযন্ত্রের ত্রুটি তথা ছিদ্রের ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার পরিবারের খুব কাছের কোনো স্বজনের জন্মগত হৃদরোগ থাকলেও তা পরিবারের কোনো কোনো শিশুর মধ্যে দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় মা হাম, পক্স, ভেরিসেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস বা টক্সোপ্লাজমা পরজীবী ইত্যাদিতে আক্রান্ত হলে তাদের সন্তানরা জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে।

যে মায়েরা ৩০ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ করেন, তাদের সন্তান ক্রোমোজোমাল ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে পারে। সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে হৃদযন্ত্রে ছিদ্রের হার বেশি। অন্যান্য ক্রোমোজমাল রোগ যেমন এডওয়ার্ড সিনড্রোম, পাতাও সিনড্রোম, টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের হৃদযন্ত্রের পর্দায়ও জন্মগতভাবে ছিদ্র থাকতে পারে। যে মায়েরা গর্ভাবস্থায় কোকেন, হেরোইন ইত্যাদি ধরনের মাদক সেবন করেন, তাদের সন্তানরাও সমস্যা নিয়ে জন্ম নিতে পারে।

সাধারণত কোন পর্যায়ে এসে শিশুদের হৃদযন্ত্রের সমস্যা ধরা পড়ে?

মূলত মানুষের হৃদযন্ত্রে ওপরে নিচে দুটি করে চারটা চেম্বার বা প্রকোষ্ঠ আছে। ওপরের দুটিকে বলা হয় অলিন্দ আর নিচের দুটিকে বলা হয় নিলয়। ওপরেরগুলোতে ছিদ্র থাকলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে এএসডি আর নিচেরটাতে ছিদ্র থাকলে তাকে ভিএসডি বলা হয়। আরেক ধরনের জন্মগত হৃদরোগ যাকে আমরা এভিএসডি বলে থাকি, সেক্ষেত্রে অলিন্দ-নিলয় উভয়ের পর্দায় ছিদ্র থাকে। হার্টের অলিন্দের পর্দায় ছিদ্র জন্মের আগেই থাকে এবং ছিদ্র জন্মের পরও  থেকে যেতে পারে, যাকে আমরা পিএফও বলে থাকি। এই পিএফও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ পিএফও সারা জীবন বয়ে বেড়াতে পারেন।

দুটি সমস্যার মধ্যে এএসডি অপেক্ষাকৃত মৃদু। শিশুর বয়স যখন দু-তিন বছর হয়, তখন এএসডির আকার বড় হলে তা প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে শিশুর বুকে হৃদস্পন্দন ছাড়াও একধরনের শব্দ অনুভূত হয়। যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় মারমার বলা হয়ে থাকে। অনেকের পাঁচ-ছয় বছর বয়স পার হয়ে গেলেও ছিদ্রের আকার ছোট থাকায় রোগের লক্ষণ বা মারমারটি তেমন জোরালো হয় না। ঘটনাক্রমে কোনো অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে বা অন্য কোনো রোগ নিরীক্ষার সময় তা ধরা পড়ে।

নিলয়ের পর্দার ছিদ্র অর্থাৎ ভিএসডি এএসডির তুলনায় গুরুতর রোগ। ভিএসডির আকার ছোট হলেও তার লক্ষণ তথা মারমার অনুভূত হয়। এমনকি শিশুর মা তাকে বুকের দুধ পান করানোর সময় বুকের সেই অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পান। এএসডি বড় আকার ধারণ করলে এবং যথাসময়ে চিকিৎসা না পেলে শিশু হার্ট ফেইলিউরের শিকারও হতে পারে। ভিএসডির আকার ছোট থাকলেও তার কারণে শিশু বারবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। পরিবারের কারো অ্যালার্জি না থাকলেও শিশু বারবার নিউমোনিয়া, অ্যাজমা বা ঠাণ্ডাজ্বরে আক্রান্ত হয়। সে সময় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তার রোগের আসল কারণ হিসেবে হৃদযন্ত্রের পর্দার ছিদ্র ধরা পড়ে।

এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি কী?

ইকো কালার ডপলার পরীক্ষায় হার্টের পর্দার ছিদ্র শনাক্ত করা হয়। রোগ জটিল আকার ধারণ করলে সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে, ইসিজি করতে হয়। এএসডির আকার সাধারণত সাত মিলিমিটারের কম থাকলে তা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়। নিয়ে  বাড়তি দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। তবে ছিদ্র যদি মিলিমিটারের বেশি হয় তখন ছিদ্র আপনাআপনি বন্ধ হয় না। সে ক্ষেত্রে ফুসফুসের প্রেসার বেশি থাকলে কিছু ওষুধ দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ক্ষেত্রে শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা চেষ্টা করেন যে, শিশুর বুক না কেটে ডিভাইস বা বোতাম পদ্ধতিতে ছিদ্র বন্ধের। যদি সেটা না করা যায় তাহলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে।

ফুসফুসের প্রেসার মাত্রাধিক পর্যায়ে চলে গেলে কার্ডিয়াক এনজিওগ্রাম পরীক্ষা করে তার ফুসফুসের প্রেসার সহনশীল পর্যায়ে আছে কিনা তা দেখে ডিভাইস বা সার্জারির পক্ষে চিকিৎসকরা মত দিয়ে থাকেন। অস্ত্রোপচার সাধারণত দুই ধরনের হয়। ছিদ্র ছোট হলে মিনিমাল ইনভেসিভ সার্জারি বা বুকের বাঁ-দিকে ছোট ছিদ্র করে পর্দার ছিদ্র বন্ধ করা হয়ে থাকে। ছিদ্র বড় হলে বা তা অস্বাভাবিক জায়গায় থাকলে সেক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারির প্রয়োজন হয়।

এএসডির ক্ষেত্রেও জন্য অস্ত্রোপচার সাত-আট বছরের মধ্যেই করে ফেলতে হবে। নতুবা ১০ বছরের দিকে রোগটি আরো জটিল আকার ধারণ করে তখন সার্জারি করেও কোনো লাভ হয় না। মনে রাখতে হবে শিশুদের জন্মগত হৃদরোগের ক্ষেত্রে বয়স কোনো ব্যাপার নয়, রোগের জটিলতা দেখা দিলে বা এএসডি বা ভিএসডির কারণে শিশুর বারবার অসুস্থ হয়ে পড়লে শিশুকে ডিভাইস বা অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে হবে।

চিকিৎসার ব্যয় কেমন হয়?

বাংলাদেশে সরকারি একটি মাত্র হাসপাতালে (জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল) স্বল্পমূল্যে শিশুদের এই অস্ত্রোপচার করা সম্ভব। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিশোর বয়সে এএসডি ভিএসডি অপারেশন করা হয়। এএসডির ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ ৮০ হাজার টাকা। আর ভিএসডির ক্ষেত্রে খরচ লাখ টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দেড় লাখ টাকার মধ্যে সার্জারি করা সম্ভব। ঢাকা শিশু হাসপাতালে খরচ পড়বে - লাখ টাকা, হার্ট ফাউন্ডেশনে হবে লাখ ৮০ হাজার থেকে লাখ ৩০ হাজার টাকা। আর অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে আড়াই থেকে সাড়ে লাখ টাকায় অস্ত্রোপচার সম্ভব।

সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হলে কী ধরনের ঝুঁকি রয়েছে? চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা কী?

সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। সীমাবদ্ধতার মধ্যে মোটা দাগে বলতে হবে আমাদের দেশে দক্ষ শিশু কার্ডিয়াক সার্জন সংখ্যায় অপ্রতুল। বিশেষ করে বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষেত্রে একধরনের উদাসীনতা দেখা যায়। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে শিশু কার্ডিয়াক সার্জন গড়ে তোলার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বিষয়টির বিকাশ হলে দেশেই কম খরচে শিশুদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে। এজন্য জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে শিশুদের কার্ডিয়াক সার্জারি কোর্স (এনআইসিভিডি) খুলতে হবে।

ধরনের শিশুদের জন্য কোনো বিশেষ যত্ন প্রয়োজন আছে কি?

প্রথমত অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। শিশুর রোগের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে শিশু চিকিৎসক তাদের পরামর্শে শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে। বারবার নিউমোনিয়া হলে অবশ্যই শিশুর জন্মগত হৃদরোগ আছে কিনা তা শনাক্ত করতে হবে। শিশুকে পুষ্টিকর খাবার যেমন ডিম, দুধ, মাছ, মাংস খাওয়াতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। সব শিশুকে সরকারি ইপিআই কর্মসূচি অনুযায়ী রুবেলা ভ্যাকসিন দেয়া নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন