
সিনেমা কখনো না কখনো সময়ের প্রতিচ্ছবি। সিনেমা কোনো কোনো ভৌগোলিক অবস্থানেরও প্রতিচ্ছবি। গল্পে যে সময় যে স্থান দেখানো হয়, তা কতটা স্পষ্ট ও বাস্তব প্রতিচ্ছবি, তা সিনেমার গুণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। হলিউডের সিনেমায় লস অ্যাঞ্জেলেস, ফরাসি সিনেমায় প্যারিস, বলিউডের সিনেমায় মুম্বাই আমরা দেখে থাকি। দক্ষিণ ভারতীয়, বিশেষত তামিল সিনেমায় উঠে আসে চেন্নাই। মজার ব্যাপার তামিলনাড়ুতে তৈরি হওয়া ছাড়াও বলিউড বা অন্যান্য সিনেমায়ও চেন্নাইয়ের উপস্থাপনা পাওয়া যায়। দর্শক তা দেখে মনে করে চেন্নাই শহর ঠিক এমনই। কিন্তু সব সিনেমার চেন্নাই বাস্তবের চেন্নাইকে প্রকাশ করে না। গল্পের কারণে, কখনো গল্পকার বা পরিচালকের কারণে, চেন্নাইয়ের রূপ বদলে যায়।
সাম্প্রতিক ও পুরনো বহু সিনেমায় চেন্নাই এসেছে। এর মধ্যে কিছুদিন আগে মুক্তি পেল বিনীত শ্রীনিবাসনের ‘হূদয়ম’। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র অরুণকে আমরা চেন্নাইয়ে পড়তে আসতে দেখি। সেখানে সে নিজের এলাকা থেকে তুলনামূলক বড় শহরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তার জন্য চেন্নাই একটা বড় শহর, যেখানে সে মুক্তি খুঁজে পায়। সিনেমায় চেন্নাইয়ের প্রচলিত একটি চিত্র দেখানো হয়েছে। এছাড়া এ সিনেমায় চেন্নাই এসেছে একজন ‘আউটসাইডারের চোখ দিয়ে’। অন্যদিকে নেটফ্লিক্সের রোমান্টিক ঘরানার সিনেমা ‘মীনাক্ষি সুন্দরেশ্বর’। এ সিনেমায়ও মূল গল্পের পাশে চেন্নাই ও তামিল সংস্কৃতি এসেছে অনুষঙ্গ হিসেবে। সাধারণ দর্শকের মনে হয়েছে এটিই তামিল সংস্কৃতি কিন্তু তামিলদের বক্তব্য হলো, উপস্থাপন বাস্তব থেকে বহু দূরের। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে মনোজ কুমার লিখেছেন, ‘এ সবই আসলে পডোশন সিনেমা থেকে অণুপ্রাণিত তামিল সংস্কৃতি।’ অর্থাৎ অসম্পূর্ণ।
‘ভানাক্কম ভায়াভাইক্কুম চেন্নাই’
প্রবাদটির অর্থ চেন্নাইয়ে সবার আমন্ত্রণ। আতিথ্যপরায়ণতা ও সুযোগের কথা বোঝানো হয় এ দিয়ে। চেন্নাই শহরকে নিয়ে আছে নানা রকম স্বপ্ন। সিনেমা সে স্বপ্নের একটি অংশ। রজনীকান্ত এই শহরে এসে সুপারস্টার হয়েছেন। এ শহরভিত্তিক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির প্রাণ প্রকাশ রাজ, অর্জুন শারজার মতো তারকারা। সবাইকে তৈরি করেছে চেন্নাই। ফলে চেন্নাই নিয়ে মানুষ ও দর্শকের আগ্রহের শেষ নেই। এখনো বহু তরুণ নির্মাতা চেন্নাইয়ের আগ্রহম স্ট্রিটে আড্ডা দিতে দিতে ফিল্টার কফি পান করেন। সত্যম সিনেমায় নতুন একটা সিনেমা দেখে তারা ম্যারিনা বিচ ঘুরে বেড়ান। চেন্নাইয়ের এ চিত্র কোনো না কোনোভাবে দর্শক ও সাধারণের মনে ছাপ রেখে গিয়েছে। হূদয়ম বা মীনাক্ষি সুন্দরেশ্বর তাই চেন্নাইয়ের এমন একটি ধারণা রেখেই দায়িত্ব শেষ করে।
সিনেমায় চেন্নাইয়ের উপস্থাপন বহু পুরনো। ১৯৭৭ সালে কে বালাচন্দ্রের পরিচালনায় নির্মিত হয়েছিল ‘পাটিনা প্রবেশম’। চেন্নাইয়ের মতো একটি মেট্রোপলিস যেমন ও নাগরিকরা শহর থেকে যা চায় তা-ই তুলে আনা হয়েছিল সিনেমাটিতে। একটি পরিবার একটি বড় শহরে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে যে সংগ্রাম করে তার চিত্র এ সিনেমা। ‘আ্যাান্টি-সিটি’ সিনেমাটির শেষে পরিবারটি গ্রামেই ফিরে যায়। হূদয়মের মতো এ সিনেমা স্বপ্ন দেখায় না। বড় শহরে স্বপ্ন ভাঙার কথাই বলে। অর্থাৎ চেন্নাই শহরটিতে বাঁচা সহজ নয়।
একটা লম্বা সময় ধরে সিনেমায় উত্তর চেন্নাই অপরাধের কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন হতো। অনেকটা আশি-নব্বইয়ের দশকে রাম গোপাল ভার্মার নির্মিত সিনেমাগুলোর মতো। মুম্বাইয়ের অপরাধ, উঁচুতলার সঙ্গে নিচুতলার বিরোধ আর অন্ধকার জগতের কথা বলত। উত্তর চেন্নাইয়ের বস্তি, অপরাধ, অশিক্ষার বাস্তবতা ছিল এসব সিনেমার কেন্দ্রীয় গল্প। অবশ্য আজকের নেটফ্লিক্সের মতো ডার্ক থিমে তারা সিনেমা নির্মাণ করতেন না। তাদের গল্পটা থাকত অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর গল্প নিয়ে। এ ধারার গল্প ও চরিত্র দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—প্রথমত, ধনীদের জন্য কাজ করা পদাতিকের মতো লোকজন; দ্বিতীয় ভাগে থাকে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষের দল, যারা সত্য ও নীতি থেকে বিচ্যুত হয় না। ভেটরিমারান ও পা. রঞ্জিতের আগের সিনেমাগুলোয় চেন্নাই ও তার মানুষকে উপস্থাপনের এই ছিল সাধারণ ধারা।
উত্তর চেন্নাইকে উপস্থাপনের ধরন বদলে যায় এই শতকের শুরুর দশকে। জেমিনি (২০০২), আরু
(২০০৫) প্রভৃতি সিনেমার ‘ভাদা’
চেন্নাইয়ের (কেন্দ্রীয় অঞ্চল) নিজস্ব নায়ককে পাওয়া যায়। আর চেন্নাইয়ের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও মানুষ উঠে আসতে থাকে সিনেমাগুলোয়। এর মধ্যে সেলভাবাঘবনের ২০০৬ সালের সিনেমা ‘পুধুপেট্টাই’
চেন্নাইয়ের বাস্তব উপস্থাপনের জন্য ক্ল্যাসিকের মর্যাদাই পেয়ে যায়। চেন্নাইকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ভেটরিমারানের ‘পোল্লাধাবান’
(২০০৭) বেঞ্চমার্ক হিসেবে বিবেচিত হয়। চেন্নাইয়ের সব পুরুষ ‘রাওডি’
হতে চায় না। সিনেমায় যে রুক্ষতা ও অ্যাকশনের ধারা তৈরি হয়েছিল তার বাইরে নাগরিক জীবনের বাস্তবতা দেখানো হয়েছিল ধানুশ, বিজয় সেতুপতি অভিনীত এ সিনেমায়। সিনেমা আর চেন্নাইয়ের উপস্থাপন বদলেছিলেন পা. রঞ্জিতও। আট্টাকাথি, মাদ্রাজ, সারপাট্টা পারাম্বারাই নতুন ধারার নাগরিক সিনেমা।
পা. রঞ্জিতের এই নাগরিক ধারার পাশপাশি এসে দাঁড়ায় ভেটরিমারানের ভাদা চেন্নাই। পুরনো ধারার সেই বস্তিবাসী নিচুতলার মানুষের গল্পের সঙ্গে আসে ব্যবসা ও রাজনীতিতে ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে থাকা শ্রেণীর গল্প। ধানুশের আন্বু চরিত্রটি এই পরিবর্তনের প্রতিনিধি। চেন্নাইয়ে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, আর সে পরিবর্তনের রূপ সিনেমায় রাখতে চেষ্টা করেছেন এ প্রজন্মের নির্মাতারা। এর মধ্যে লোকেশ কনগরাগের ‘মানাগারাম’
একটি অনন্য প্রচেষ্টা। চারটি ভিন্ন গল্প যুক্ত করে ক্যারিয়ারিস্ট, সুবিধাবাদী, মফস্বল থেকে বড় শহরে এসে বড় হতে চাওয়ার স্বপ্ন এবং ক্ষমতাধরের গল্প এনেছেন তিনি। বিভিন্ন শ্রেণী ও চরিত্রের মানুষের সঙ্গে এ সিনেমায় চেন্নাইয়ের একটি ‘প্রায় পূর্ণাঙ্গ’
চিত্র এসেছে।
শহর বদলায় শহরের নিয়মে। সে শহরের গল্পগুলো নির্মাতারা ধরেন নিজেদের মতো করে। তবে কখনো কখনো সিনেমায় বাণিজ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে উপস্থাপন বদলানো হয়। আর সময়ের সঙ্গে বদলায় মানুষের রুচি। সিনেমায় তাই দেখা যায়, এক শহরের বহু রূপ। তবে নেটফ্লিক্স কিংবা বলিউডের সিনেমায় চেন্নাইকে চেনা যায় না। চেন্নাই থাকে তামিল নির্মাতাদের বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে নির্মিত সিনেমায়।