পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্যাস অনুসন্ধান

বাপেক্স চায় চীনা কোম্পানি পেট্রোবাংলার পছন্দ ভারতীয় ওএনজিসি

আবু তাহের

দেশের স্থলভাগে সমতলের পাশাপাশি এবার পার্বত্যাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) এজন্য পেট্রোবাংলার কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আগ্রহপত্র (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট বা ইওআই) আহ্বান করে সংস্থাটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছয় কোম্পানি পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধানের আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রাথমিক বাছাই শেষে চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে তিন কোম্পানি। সেখান থেকে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়েই পাহাড়ে গ্যাস সন্ধানে নামবে বাপেক্স।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধানে যে তিনটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড (ওভিএল), রাশিয়ার গ্যাজপ্রম চীনা একটি কোম্পানি। তবে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে ওএনজিসি চীনা কোম্পানিটির মধ্যেই চলছে জোর প্রতিযোগিতা। যদিও গ্যাস অনুসন্ধানে অভিজ্ঞতা বিবেচনায় চীনা কোম্পানিটির বিষয়েই সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বাপেক্সের। অন্যদিকে দেশের সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান তত্পরতা বিবেচনায় ওএনজিসিকে উপযুক্ত মনে করছে পেট্রোবাংলা। এখন কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় কোন কোম্পানিকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে, বিষয়ে পেট্রোবাংলা কিংবা বাপেক্স দুই পক্ষই পরিষ্কার কিছু জানায়নি। প্রতিষ্ঠান দুটির শীর্ষ পর্যায় থেকে অবশ্য জানা গিয়েছে, পার্বত্যাঞ্চলে দেশের চাহিদা অনুযায়ী যে কোম্পানি শর্তপূরণ করতে পারবে তাদেরই সঙ্গে নেবে বাপেক্স।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধানে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে আমরা কাজ দিতে চাই। বিশেষ করে গ্যাস অনুসন্ধানে যেসব নির্দেশনা শর্ত রয়েছে, সেগুলো পূরণ হলেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করব।

পাহাড়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেসব এলাকায় গ্যাসের উপস্থিতির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বাপেক্সের হাতে। ফলে কোথায় সম্ভাব্য গ্যাস পাওয়া যেতে পারে সে ধারণা নিয়েই অনুসন্ধানে নামবে সরকারি সংস্থা। এর মধ্যে পার্বত্যাঞ্চলের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ির চাংগুটাং, শিশাক, গোবামুড়া, বরকল এলাকায় তারা যৌথভাবে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে চায়, যেটি পেট্রোবাংলা ব্লক ২২/ এবং বি।

পেট্রোবাংলা বাপেক্স সূত্র জানিয়েছে, পাহাড়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনুমোদন নিয়ে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আগ্রহপত্র চেয়েছিল বাপেক্স। এর ভিত্তিতে ছয়টি কোম্পানি ইওআই জমা দেয়। এরপর সেগুলোকে দরপত্র আহ্বানের জন্য রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল (আরএফপি) দেয়া হয়। মূলত প্রস্তাবে পেট্রোবাংলা বাপেক্সের যেসব চাহিদা শর্ত থাকে সেগুলোই দেখা হয়। সেখান থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে মোট তিনটি কোম্পানি সেই শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। সব ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এরই মধ্যে কোম্পানি তিনটির তালিকা পাঠানো হয়েছে পেট্রোবাংলার কাছে। এর মধ্যে চীনা কোম্পানির প্রস্তাবটিকে যথোপযুক্ত মনে করে সুপারিশও করেছে বাপেক্সের দরপত্র-সংক্রান্ত কমিটি, যা এরই মধ্যেই পেট্রোবাংলার কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে পেট্রোবাংলা পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশকে কাজে সংযুক্ত করতে চায়। যদিও পেট্রোবাংলার সেই আগ্রহের কারণ জানা যায়নি।

বাপেক্স বলছে, চূড়ান্ত ধাপে যে তিনটি কোম্পানি নির্বাচিত হয়েছে তাদের কারিগরি আর্থিক সক্ষমতার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে। খতিয়ে দেখা হবে অতীত অভিজ্ঞতা। তারপর একটি নির্দিষ্ট মার্কের (নম্বর) মাধ্যমে একটিকে চূড়ান্ত করে তাদের সঙ্গে বাপেক্স যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কোম্পানি গঠন করবে। বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। মূলত তারাই এসব কোম্পানির বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে। বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধানে মূলত যেসব প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা এবং আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে, তাদেরই প্রাধান্য দেয়া হবে।

দেশের পাহাড়ি এলাকা চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি রাঙ্গামাটিতে গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ প্রথম আলোচনায় আসে ২০১০ সালে। যৌথ উদ্যোগে অনুসন্ধানের কাজটি করতে রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলন কোম্পানি বাপেক্স একাধিক বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে আলোচনাও করে। সে সময়ে প্রাথমিকভাবে চীনা কোম্পানি সিনোপ্যাকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে নানা কারণ দেখিয়ে তখন কোম্পানিটিকে বাদ দেয়া হয়। এরপর ২০১১ সালেও বাপেক্সের পক্ষ থেকে পাহাড়ি এলাকায় যৌথভাবে গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাশিয়া, চীন, ভারত, মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডের আটটি প্রতিষ্ঠানের কাছে আগ্রহপত্র চাওয়া হয়। এর মধ্যে কেবল ভারতের ওএনজিসি চীনের সিনোপ্যাক প্রস্তাব জমা দেয়। তবে ওএনজিসির প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৫ সালে পার্বত্য এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের পুনরায় উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই সময় সিনোপ্যাককে বাদ দিয়ে চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান জিওজাদে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে কাজের জন্য নির্বাচন করা হয়। যদিও পরে ওই কোম্পানি পিছু হটে।

বর্তমানে তীব্র গ্যাস সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিদ্যমান চাহিদা মেটাতে রেশনিংয়ের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে পরিস্থিতি মোকাবেলার। পাশাপাশি গ্যাসের নতুন উৎস খুঁজতে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। দেশের এমন সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে অনাবিষ্কৃত এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের কথা বারবার বলে আসছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশের স্থলভাগের পার্বত্য এলাকায় গ্যাসের বড় মজুদাবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, পার্বত্য এলাকায় গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশের যে ভূগঠন তাতে স্থলভাগে এখনো গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় বৃহৎ কোনো কাজ এখনো হয়নি। ফলে এসব এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান করা গেলে আরো বড় আকারে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন