আনন্দ রূপ নিল বিষাদে

পঞ্চগড়ে নৌকা ডুবে শিশুসহ ২৪ জনের মৃত্যু

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে গতকাল বিকালে নৌকাডুবির পর উদ্ধার করা মরদেহ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে যাত্রীবোঝাই নৌকাডুবিতে নারী-শিশুসহ অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মহালয়ার দিনে গতকাল বিকালে বোদা উপজেলার আউলিয়া ঘাটের দুর্ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছে বহু যাত্রী। খবর পেয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ দমকল বাহিনী। প্রশাসনের সঙ্গে উদ্ধারকাজে নেমেছে স্থানীয়রাও। মৃতদের পরিবারপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এদিকে করতোয়ার পাড়ে ভিড় করছে হাজারো মানুষ। স্বজন হারানোর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ। নৌকায় ছিল এমন স্বজন-পরিজনের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছে তারা। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ প্রশাসন।

নৌকাডুবির ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন লক্ষ্মী রানী (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫), প্রিয়ন্তী (), শোভা রানী (২৭), দীপঙ্কর (), পিয়ন্ত রানী (), রূপালী ওরফে খুকি রানী (৩৫), প্রলিমা রানী (৫৫), তারা রানী (২৫), সনেকা রানী (৬০), ফাল্গুনী রানী (৪৫), প্রমিলা দেবী (৭০), ধনবালা (৬০), সুনিতা রানী (৬০), সফলতা রানী (৪০), শ্যামলী রানী ওরফে শিমুলী (৩৫), উশোষী রানী (), তনুশ্রী রানী (), শ্রেয়শী রানী (), বিলাস চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানী (১৪), জ্যোতিষ চন্দ্র (৫৫), বিষ্ণু () নৌকার মাঝি হাশেম আলী (৭০) এদের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা দেবীগঞ্জ উপজেলায় এবং ঠাকুরগাঁওয়ে। একই পরিবারের রয়েছে তিনজন।

করতোয়া নদীতে নৌকা ডুবে প্রাণহানির ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পৃথক বার্তায় রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। নিজ নির্বাচনী এলাকায় নৌকাডুবির ঘটায় গভীর শোক দুঃখ প্রকাশ করেছেন রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনও।

স্থানীয়রা জানান, শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়। সেই দেবীপক্ষের সূচনায় বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে বসে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। প্রতি বছরের মতো দেবী আবাহনের উৎসবে যোগ দিতে পাঁচপীর, বোদা, মাড়েয়া, ব্যাঙহারি এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে মাড়েয়া বাজার এলাকার আউলিয়াঘাট থেকে ৭০-৮০ যাত্রী নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রওনা হয়। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর সেটি দুলতে শুরু করে। তাই নৌকাটিকে ঘাটে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন মাঝি। একপর্যায়ে তীরে ভেড়ার আগেই ডুবে যায়। উৎসবের রঙ মুহূর্তেই রূপ নেয় বিষাদে। নারী শিশুদের অনেকেই স্রোত ঠেলে তীরে আসতে পারেনি। তবে সাঁতরে প্রাণে বেঁচেছে অনেকে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী থাকার কারণেই নৌকাটি ডুবে গিয়েছে বলে জানায় যাত্রীরা। মৃতদের মধ্যে ১২ নারী, আট শিশু চারজন পুরুষ। তাদের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পর মৃত্যু হয়েছে আটজনের।

নৌকাটি যখন করতোয়ার জলে ডুবছিল তখন পাড়েই ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আজম আলী। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আউলিয়া ঘাটে অনেক লোক নিয়মিত পারাপার হয়। পূজা উপলক্ষে এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচুর লোকজন পার হচ্ছে। এর মধ্যে আজকে হঠাৎ নৌকা ডুবে গিয়ে অনেক লোক মারা গিয়েছে। নদী পার হয়ে মন্দিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি থেকে এসেছিলেন এক নারী। কিন্তু ভিড়ের কারণে দুর্ঘটনাকবলিত নৌকায় তিনি ওঠেননি। আর তাতেই তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন বলে মনে করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, পঞ্চগড়ে দুদিন ধরে ভারি বৃষ্টি উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে করতোয়া নদীতে পানি বেড়েছে। প্রবল স্রোতের মধ্যে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার কারণেই মাঝ নদীতে নৌকাটি উল্টে যায়। সময় সাঁতার জানা যাত্রীরা তীরে উঠতে পারলেও বেশির ভাগ নারী-শিশু পানিতে ডুবে যায়। তাদের চিত্কারে এলাকার লোকজন ছুটে এসে অনেককে উদ্ধার করে। পরে জেলা, উপজেলা, পুলিশ প্রশাসন ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হলে তারা এসে উদ্ধার তত্পরতা শুরু করে।

মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু আনছার মো. রেজাউল করিম বলেন, স্থানীয় নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, মহালয়া উপলক্ষে মানুষের চাপ বেশি ছিল। প্রায় সব নৌকা বেশি করে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। দুর্ঘটনাকবলিত ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল ৩৫-৪০ জন। অথচ সেখানে ৮০ জনের বেশি উঠেছিল।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে উদ্ধারকাজ তদারক করা বোদা উপজেলা কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোলেমান আলী জানান, শনাক্তের পর মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সেই সঙ্গে মরদেহ সত্কারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারগুলোকে দেয়া হবে ২০ হাজার টাকা করে। আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।

জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিল নৌকাটিতে। ছোট নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী তোলার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। প্রাণহানি হয়েছে এতগুলো মানুষের। দুর্ঘটনায় আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে খোলা হয়েছে জরুরি তথ্য কেন্দ্র। দুটি সেলফোন নম্বর দিয়ে নিখোঁজ কিংবা মৃতদের শনাক্তসহ যেকোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে বলেছে জেলা প্রশাসন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন