অনুমোদনহীন ছোট কারখানার তরল বর্জ্যে চট্টগ্রামে বাড়ছে দূষণ

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

বন্দর শহর চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। কিন্তু শিল্প-কারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে পানি পরিবেশের দূষণ মাত্রা ছাড়াচ্ছে। বিশেষত ডায়িং টেক্সটাইল মিলের বর্জ্যে পানি দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের প্রধান দুই নদী কর্ণফুলী হালদার দূষণে জলজ প্রাণীদের টিকে থাকাই ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পরিবেশ দূষণের তালিকায় প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষে রয়েছে টেক্সটাইল খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোয় তরল বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা থাকলেও অনুমোদনহীন ছোট কারখানাগুলোয় নেই। এসব কারখানা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, যারা পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে কাজ করেন, তাদের সবসময় মনিটরিং করা হয়। কিন্তু অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করে না। এমনকি তাদের ইটিপি স্থাপন করার মতো জায়গা নেই। অন্যদিকে ইটিপি ব্যবহার না করে তরল বর্জ্য নিঃসরণ করা হলে ড্রেন বা খাল দিয়ে তা নদীতে মিশে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনছে বলে মনে করছে পরিবেশ আধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় ১১০টি বড় প্রতিষ্ঠান আছে, যারা লাল তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে টেক্সটাইল খাতের ডায়িং অ্যান্ড ওয়াশিং প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪০টিরও বেশি। অনুমোদনহীন ছোট কারখানার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। বাস্তবে এসব কারখানার সংখ্যা আরো বেশি। এমনকি গত ১০ বছরে বৈধ অবৈধ শতাধিক ওয়াশিং ডায়িং কারখানাকে কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এদিকে সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিভিন্ন অভিযানে ইটিপিবিহীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই ইটিপি বা পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। সম্প্রতি অভিযানে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মেসার্স সাফ ড্রেসিং, মেসার্স ডেনিস ওয়াশিং ইন্ডাস্ট্রিজ, লিমেক্স ওয়াশিং, শাহজালাল ওয়াশিং প্লান্ট, উইন ওয়াশিং প্লান্ট, লুমিনাস অ্যাকসেসরিজ, জেপিএস অ্যাকসেসরিজ, হোসেন ওয়াশিং প্লান্ট, সান ওয়াশিং প্লান্ট, মক্কা ওয়াশিং। এদিকে গত কয়েক মাসের অভিযানে অনুমোদনহীন অন্তত অর্ধশতাধিক কারখানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রামে এখন যেসব ডায়িং ওয়াশিং কারখানাগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো জনমানবহীন এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে। একটি বা দুটি ঘর নিয়ে মালিকরা কাজ পরিচালনা করছেন। কাপড় ওয়াশ করার সময় যেসব কেমিক্যালযুক্ত তরল বর্জ্য বের হচ্ছে, সেগুলো ইটিপি ব্যবহার না করার কারণে সরাসরি ড্রেনের মাধ্যমে নগরীর বিভিন্ন খালে গিয়ে মিশছে। অনেক কারখানায় ইটিপি স্থাপনের কোনো জায়গায় নেই। অনেক কারখানার সাইনবোর্ড পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের (মহানগর) উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি আমরা বিভিন্ন ওয়াশিং ডায়িং কারখানায় অভিযান চালিয়েছি। বেশির ভাগ কারখানা ছোট। ছোট ড্রেনের মাধ্যমে এসব কারখানার তরল বর্জ্য নগরীর খালে মিশে যাচ্ছে এবং কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। সাধারণত ওয়াশিং বা ডায়িং কারখানা আমাদের লাল ক্যাটাগরির হয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য পরিবেশের সঙ্গে মিশে সেটা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। গত কয়েক মাসে রকম অনেক কারখানার খোঁজ পেয়েছি, যারা কোনো ধরনের ইটিপিই ব্যবহার করেন না। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। আমরা তাদের পরিবেশ আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাগারের কর্মকর্তারা বলছেন, পোশাক খাতের ওয়াশিং, টেক্সটাইল, ডায়িং অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কারণ শিল্পগুলো থেকে যে তরল বর্জ্য নির্গত হয়, সেগুলো পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ছোট কারখানাগুলো যদি এক জায়গায় থাকে তাহলে ক্লাস্টার ইটিপি (কয়েকটি কারখানার জন্য একটি ইটিপি) নির্মাণ করে ক্ষতি নিরসন করা যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিন্নতার কারণে তরল বর্জ্য আলাদা হয়।

পরিবেশবিদ মো. ইদ্রিশ আলী বলেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্গত তরল বর্জ্যের বেশির ভাগই অপরিশোধিত। বর্জ্যগুলো বিভিন্ন ড্রেন কিংবা খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। তরল বর্জ্যের কারণে চট্টগ্রামের পরিবেশ বিনষ্ট তো হচ্ছেই, সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর দূষণ বাড়ছে নিয়মিত। দূষণ কমাতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরো কঠোর অবস্থানে যেতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন