দেশ-বিদেশে ফার্মাসিস্টের বহুমুখী ক্যারিয়ার

ফার্মেসি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা যা রসায়নশাস্ত্রের সঙ্গে জীববিজ্ঞানের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞানের শাখায় মূলত ওষুধ উৎপাদন, এর নিরাপদ সঠিক ব্যবহার, মান নির্ধারণ, বিতরণ, পরিবেশন সংরক্ষণ বিষয়ে আলোচনা গবেষণা হয়। ফার্মেসি ডিগ্রি সম্পন্নকারীদের পরিচয় ঘটে ফার্মাসিস্ট হিসেবে। এক্ষেত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টরা গ্রেড, ডিপ্লোমাধারীরা বি গ্রেড এবং তিন মাস মেয়াদি সার্টিফিকেটধারীরা সি গ্রেড ফার্মাসিস্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাদেশে ফার্মেসি বিষয়ে শিক্ষার যাত্রা হয় ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিষয়ে বিভিন্ন ডিগ্রি দেয়া হয়।

ওষুধ শিল্প স্বাস্থ্যসেবা খাতে ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটের প্রয়োজনীয়তা চাহিদা : দেশে সরকারি তালিকাভুক্ত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৬৯টি। এসব প্রতিষ্ঠান দেশের ওষুধ চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে। দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৬টির প্রায় ৩০০ ধরনের ওষুধ বিশ্বের ১৬০টি দেশে রফতানিও করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার ১৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে এবং আন্তর্জাতিক বাজার ৬৫০ কোটি টাকারও বেশি। খাতে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় শতাংশের ওপরে। শিল্পে বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়ে থাকে প্রায় দুই লাখ মানুষের মেধা শ্রমের মাধ্যমে, যাদের বেশির ভাগই গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট। তাই ওষুধ উৎপাদনকারী এসব প্রতিষ্ঠানে ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটদের প্রয়োজনীয়তা এবং অবদান সবচেয়ে বেশি। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন শাখায় যেমন ওষুধ উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, সূত্রায়ণ বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, বিপণন, ওষুধের কার্যকারিতা যাচাইকরণ, মানবদেহে ওষুধের প্রয়োগ, প্রভাব আন্তঃক্রিয়া বিশ্লেষণ, ওষুধ সংরক্ষণ ইত্যাদি শাখায় বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা। বিষয়ে রেনাটা লিমিটেড জেনারেল ম্যানেজার (প্রডাকশন) মো. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ফার্মেসি শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে প্রডাকশন, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স, মার্কেটিং ইত্যাদি সেক্টরে ক্যারিয়ার তৈরির সুযোগ তুলনামূলক বেশি।

দেশ-বিদেশে ফার্মেসির বহুমুখী ক্যারিয়ার: বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটদের কদর ইন্ডাস্ট্রিতে বেশি হলেও সময়ের সঙ্গে চাকরির ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে ফার্মাসিস্টদের বহুমুখী ক্যারিয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে চাকরির সুযোগ রয়েছে। সরকারি বিভিন্ন কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, সশস্ত্র বাহিনী, সরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে উচ্চ বেতনে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ নেয়া হয়। সম্প্রতি কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে ফার্মাসিস্ট, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট, ফার্মেসি ম্যানেজার বা তথ্য বিভাগে নিয়োগ নেয়া হচ্ছে। ফার্মেসিগুলোয় পণ্য ব্যবস্থাপনা, পণ্যের মানোন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিভাগে স্নাতক ফার্মাসিস্টদের চাহিদা রয়েছে। রাজধানীতে সাতটি মডেল ফার্মেসি প্রকল্প চালু হয়েছে। এখানে একজন ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্ট সরাসরি রোগী বা ওষুধের ক্রেতার সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে ওষুধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান বিভিন্ন পরামর্শ দেন। প্রতিটি জেলায় প্রাথমিকভাবে কমপক্ষে একটি মডেল ফার্মেসি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগও রয়েছে।

বিদেশে ফার্মাসিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে হলে ওই দেশের নিজস্ব কিছু নিয়মনীতি মেনে রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত দেশে ফার্মেসি পেশা মূলত রোগীর ওষুধ সেবা ওষুধ-সংক্রান্ত পরামর্শকেন্দ্রিক। ফলে ওইসব দেশে রেজিস্ট্রার ফার্মাসিস্টরা প্রধানত হাসপাতাল কমিউনিটি ফার্মেসিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। যারা পেশাজীবী ফার্মাসিস্ট হিসেবে সনদ পান তারাই মূলত হাসপাতাল কমিউনিটি ফার্মেসিতে প্র্যাকটিস করতে পারেন। দুবাই, সৌদিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও রয়েছে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের আকর্ষণীয় বেতনে কাজ করার সুযোগ।

স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ফার্মাসিস্টের ক্যারিয়ার সম্ভাবনা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারে, ফার্মাসিস্টদের শতকরা ৫৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মেসি, ৩০ শতাংশ হসপিটাল ফার্মাসি, শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং, শতাংশ সরকারি সংস্থায় এবং শতাংশ একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কমিউনিটি কিংবা হসপিটাল ফার্মাসিতে কোনো গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ৮৫ শতাংশ ফার্মাসিস্ট কর্মরত রয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য চাই একজন করে ডাক্তার ফার্মাসিস্ট। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় এখন ৭০ হাজারের বেশি ডাক্তার কর্মরত। অথচ একজনও ফার্মাসিস্ট নেই! ২০১৮ সালের মার্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক হসপিটাল ফার্মাসিস্ট পদে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের প্রথম শ্রেণীর নবম গ্রেডে নিয়োগের জন্য গেজেট প্রকাশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট পদ শূন্য থাকায় প্রায়ই রোগীদের ভুল ওষুধ প্রয়োগের ঘটনা ঘটছে, যার ফলে দেশের স্বাস্থ্য খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। নিরাপদ কার্যকরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে দেশের প্রতিটি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের নিয়োগে দ্রুত ব্যবস্থা করা দরকার মনে করেন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা। তাই দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে বিশ্বমানের করার জন্য গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট পদটিকে বাংলাদেশ ক্যাডার সার্ভিসভুক্ত (বিসিএস) করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালগুলোয় গ্রেড ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেয়া এখন সময়ের দাবি মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

 

নুরুল মোস্তফা: ফার্মেসি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন