অভিমত

রিজার্ভ ঘাটতিতে বাণিজ্য কারসাজি ভূমিকা রাখছে

আব্দুল্লাহ মাসুম

[পূর্ব প্রকাশের পর]

রিজার্ভ ঘাটতিতে প্রত্যক্ষ উপাদান: ) আমদানি ব্যয় বাণিজ্য ঘাটতি। বিদেশ থেকে যখন কোনো কিছু আমদানি করা হয়, তখন আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলার দিয়ে। এর মাধ্যমে আমাদের রিজার্ভ থেকে ডলার ব্যয় হয়। আমদানি যদি অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান তৈরি করে, তবে তা মন্দ নয়, বরং দেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু এর বিপরীতে আমদানি যদি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে না পারে, অথবা প্রকৃতপক্ষে আমদানি না হয়ে এর আড়ালে অর্থ পাচার হয়ে থাকে তাহলে তা হবে অর্থনীতির জন্য খারাপ। গত অর্থবছরে এমনটিই ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়েছে।

কারণ, গত অর্থবছরের রেকর্ড প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের আমদানিতে খাদ্যপণ্য জ্বালানি পণ্যের ভূমিকা ছিল গৌণ, বরং এতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বস্ত্র তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি। এছাড়া লোহাসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতু, সার, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পপণ্যের রেকর্ড আমদানিও বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

এককথায় প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের আমদানিতে মূল ভূমিকা রেখেছে বস্ত্র তৈরি পোশাক খাত এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। দুই খাতে আমদানির প্রভাব দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য ডলার রিজার্ভকে ধসিয়ে দিয়েছে।

গত অর্থবছরে দেশের তৈরি পোশাক খাতের রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অথচ একই সময়ে দেশের প্রধান রফতানি খাতটির কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৫৮ শতাংশেরও বেশি।

এত বিশাল অংকের আমদানি কী বাস্তবসম্মত, না এর আড়ালে অর্থ পাচারের ষড়যন্ত্র রয়েছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত অর্থবছরে ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে সেটি অস্বাভাবিক। প্রকৃতই পরিমাণ পণ্য দেশে আমদানি হয়েছে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন। কারণ দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে অর্থনীতির কোনো সূচকেই আমদানির প্রতিফলন নেই। যে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে, সেটি দেশে এসেছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা দরকার। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঘোষণা দিয়ে কনটেইনার ভর্তি বিদেশী মদ আনার ঘটনা এরই মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি। যথাযথ অনুসন্ধান চালালে ধরনের বহু ঘটনা বেরিয়ে আসতে পারে। (বণিক বার্তা, আগস্ট, ২০২২, খাদ্য জ্বালানি আমদানি রিজার্ভকে চাপে ফেলেনি)

একদিকে বিশাল অংকের আমদানি, অন্যদিকে রফতানি ব্যয়ের তুলনায় কম। এতে তৈরি হয়েছে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি। রেকর্ড আমদানি ব্যয় দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করেছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতিতে এটি নীরবে ভূমিকা রেখেছে। এটি সহনীয় হতো, যদি এর বিপরীতে অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব তৈরি হতো। কিন্তু নানা বিশ্লেষণে দেখা গেল এত বিশাল আমদানি প্রায় বস্তুসারশূন্য।

) অর্থ পাচার। দেশ থেকে নানাভাবে অর্থ পাচার হয়ে যায়। টাকা পাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক চারটি সংস্থার রিপোর্টেই বাংলাদেশ থেকে ভয়াবহ মাত্রায় টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা প্যারাডাইস পেপার।

জিএফআইয়ের রিপোর্ট অনুসারে গত বছর দেশ থেকে প্রায় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটিতে বাংলাদেশীদের আমানত হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। পানামা প্যারাডাইস পেপার্সে ৮৪ বাংলাদেশীর টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। জিএফআইয়ের প্রতিবেদন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানা কেস স্টাডি থেকে ধরনের পর্যবেক্ষণের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। নিয়ে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়া কঠিন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে আব্দুল মোমেন গত নভেম্বরে (২০২০) এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। আর প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া ২৮টি ঘটনার মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক . ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ থেকে প্রতি বছর যে টাকা পাচার হয়, এটি তার আংশিক চিত্র। পুরো চিত্র আরো ভয়াবহ। কারণ মোট বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়। তার মতে, অর্থ পাচারের অনেক কারণ রয়েছে। এগুলো বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা নেই।

এসব বক্তব্য থেকে আশা তথ্য, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমাদের রিজার্ভ ঘাটতিতে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে অর্থ পাচার নীরব ঘাতকের ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আছে হুন্ডি প্রথা। এটি পরোক্ষভাবে রিজার্ভ হ্রাসে ভূমিকা রাখে।

বিভিন্ন জরিপ থেকে দেখা যায়, গড়ে রেমিট্যান্সের ৫৫ শতাংশ আসে হুন্ডি চ্যানেলে। আর ৪৫ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ২০১৯ অর্থবছরের এক তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬ দশমিক বিলিয়ন ডলার। তখন প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে হুন্ডিতে। আমরা সামারি করতে পারি প্রায় ১৭-২৩ বিলিয়ন ডলার এসেছে হুন্ডিতে।

মোটকথা আমদানি, রফতানির আড়ালে বাণিজ্য কারসাজি সরাসরি রিজার্ভকে হ্রাস করছে। আর হুন্ডি রিজার্ভ সমৃদ্ধি থামিয়ে দিচ্ছে। এর প্রতিকার কী হবে? নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আলোচনার শেষে বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা থাকবে।

) ব্যালান্স অব পেমেন্ট কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি

ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনের ভারসাম্য-এর হিসাব বলতে বোঝানো হয় দুটি দেশের মাঝে সংঘটিত আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক। একটি দেশে সরকার থাকে। থাকে নানা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান। রকম একটি দেশের সঙ্গে ঠিক অন্য একটি দেশের সরকার, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে যেসব লেনদেন হয় এর সামগ্রিক হিসাবকেই লেনদেনের ভারসাম্য-এর হিসাব বলা হয়। এর মধ্যে আমদানি, রফতানি, নানা পেমেন্ট, যাবতীয় কার্যক্রম আছে, যার মধ্য দিয়ে ডলার আদান-প্রদান হয়। পুরো হিসাবকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করে দেখানো হয়। যথা

. চলতি হিসাব 

. মূলধনি হিসাব

চলতি হিসাব হলো একটি দেশের সামগ্রিক আমদানি রফতানির হিসাব। এটি দৃশ্যমান হতে পারে, অদৃশ্যমান হতে পারে। দৃশ্যমান আমদানি-রফতানি হলো সব ধরনের বস্তুগত আমদানি-রফতানি। আর অদৃশ্যমান আমদানি-রফতানি হলো সব ধরনের অবস্তুগত সেবা ধরনের পণ্য। যেমন পর্যটন খাতে নাগরিক কর্তৃক বিদেশীদের প্রদত্ত সেবা। বিদেশ থেকে আগত রেমিট্যান্স, দেশে যেসব বিদেশী কাজ করেন তাদের েপ্রদত্ত অর্থ ইত্যাদি।

এবার লক্ষ্য করুন, যেসব দৃশ্য অদৃশ্য খাতের আমদানিতে অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়, তাকে বলে দায় বিপরীতে যেসব দৃশ্য অদৃশ্য খাতে রফতানিতে অর্থ যোগ হয়, তাকে বলে প্রাপ্তি

যেমন দেশে যেসব বিদেশী কাজ করেন, তাদের ডলারে পেমেন্ট দিতে হয়েছে। এতে অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে। এটি দায় আবার দেশের নাগরিক বিদেশে কাজ করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এতে বিদেশের অর্থ দেশে প্রবেশ করেছে। এটি প্রাপ্তি 

এখন যদি আমাদের দেশের সামগ্রিক দায়ের তুলনায় প্রাপ্তি বেড়ে যায় অথবা আমদানির তুলনায় রফতানি বেড়ে যায়, তাহলে আমরা বলব, আমাদের জাতীয় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে।

অন্যদিকে আমদানির চেয়ে রফতানি কম হলে আমরা বলব জাতীয় চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে।

গত অর্থবছরে (২০২১-২২) আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টের চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা পরিমাণে ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।

ঘাটতি তৈরি হলে দেশের আমদানি সক্ষমতা হ্রাস হয়। কারণ এতে রিজার্ভ কমে যায়। তখন সরকারকে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট বৃদ্ধি করতে হয়।

ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট/মূলধনি হিসাব দ্বারা বোঝানো হয় দুটি দেশের মাঝে মূলধনের স্থানান্তর। এটি নানাভাবে হয়ে থাকে। যেমন বিদেশী কেউ আমাদের দেশে বিনিয়োগ করা। ব্যবসা করা।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা ইত্যাদি। ঋণের আদান-প্রদানও এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে ঋণ দেয়া। আবার নানা সময় বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা।

আমাদের ঋণ বেড়ে যাওয়া মানে দেশে মূলধন প্রবেশ করেছে। এতে মূলধন হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখায়। এর অর্থ চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিলে, মূলধনি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখাবে। কারণ, চলতি হিসাবে ঘাটতি মানেই ঋণগ্রস্ততা বেড়ে যাওয়া। গত অর্থবছরে আমাদের ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে যুক্ত হয়েছে ১৪ দশমিক বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট দিয়ে সবসময় সমাধান হয় না। রিজার্ভ হ্রাস বেড়ে গেলে তখন চূড়ান্ত ঘাটতি থেকে যায়। আমাদের গত অর্থবছরে দুঃখজনকভাবে এটিই ঘটেছে। রিজার্ভে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট যুক্ত হওয়ার পরও দশমিক বিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের আমদানি সক্ষমতার জন্য দশমিব বিলিয়ন ডলার নেই। ঠিক কারণেই সম্প্রতি আইএমএফের কাছে সাড়ে বিলিয়ন ডলারের ঋণপ্রস্তাব করা হয়েছে। [শেষ]

 

আব্দুল্লাহ মাসুম: সিএসএএ, অ্যাওফি, বাহরাইন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন