ঢাকায় উড়ালপথ নির্মাণে মানা হচ্ছে না নির্ধারিত মানদণ্ড

সড়ক নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করবে

ঢাকার যানজট নিরসনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকার একাধিক উড়ালপথ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, ওভারপাস, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের মতো উড়ালপথ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। কিন্তু সেগুলো নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ করে নির্মাণ হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের জিওমেট্রিক ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডস অনুযায়ী উড়ালপথ নির্মাণে হেডরুমের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে দশমিক মিটার। অথচ ঢাকায় নির্মিতব্য উড়ালপথের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি মানা হচ্ছে না। হেডরুমের উচ্চতা কম হওয়ায় এসব অবকাঠামো দিয়ে যানবাহন, বিশেষ করে পণ্যবোঝাই যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটনার পাশাপাশি দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ বাংলাদেশের যানবাহনগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পণ্য বহন করে। মানদণ্ড অনুসরণ না করে কেন উড়ালপথ নির্মাণ হলো, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যায়ে তদারকির দায়িত্বরতরা এর দায় এড়াতে পারেন না। এক্ষেত্রে তাদের উদাসীনতা ছিল। সওজের নির্ধারিত মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে আরো বেশি উচ্চতার কথা বলছেন, আবার কেউ কেউ কম উচ্চতার কথা বলছেন। আমরা চাইব, প্রত্যেকের মতামত আমলে নিয়ে দ্রুতই একটি জাতীয় মানদণ্ড তৈরি করা হবে। পাশাপাশি যানবাহনে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের প্রবণতা রোধ করতে ট্রাফিক বিভাগকে সক্রিয় হতে হবে।

নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাধিক স্থানে সড়ক অবকাঠামোর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় হেডরুমের উচ্চতা রাখা হয়েছে দশমিক মিটারের কম। মেট্রোরেল, নির্মিত একাধিক ফ্লাইওভার, ওভারপাস ফুটওভারব্রিজের ক্ষেত্রেও হেডরুমের উচ্চতা রাখা হয়েছে সওজ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কম।  ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উড়ালপথটির বিমানবন্দর-তেজগাঁও অংশের অনেকটাই এখন দৃশ্যমান। অংশে এক্সপ্রেসওয়ের গতিপথে রয়েছে কুড়িল ফ্লাইওভার, বনানী ওভারপাস, মহাখালী ফ্লাইওভার বিজয় সরণি ওভারপাস। এসব অবকাঠামো অতিক্রমের সময় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হেডরুমের উচ্চতা রাখা হচ্ছে দশমিক মিটার। হেডরুমের উচ্চতা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয় পদ্মা সেতু পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পেও। বাংলাদেশে পণ্যবোঝাই একটি ট্রাকের উচ্চতা দশমিক মিটারের কাছাকাছি চলে যায়। স্বভাবতই পণ্যবোঝাই ট্রাক উড়ালপথের হেডরুমে আটকে যাবে। উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের কম উচ্চতার কারণে বেশকিছু প্রকল্পে জটিলতা দেখা  দিয়েছে। শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভারকে মেট্রোরেলের ওপর দিয়ে নির্মাণ করতে হবে। সাধারণত ফ্লাইওভার হয় নিচে মেট্রোরেল নির্মাণ করতে হয় সবার উপরে। কারণ ফ্লাইওভারে ওঠানামার র্যাম্প থাকে। তবে মেট্রোরেলে কোনো র‌্যাম্প থাকে না। অথচ ঢাকায় তার উল্টোটা করতে হচ্ছে। এতে ফ্লাইওভারের ওঠানামার র‌্যাম্প অনেক লম্বা করতে হবে। ফলে জমিও লাগবে বেশি আবার নিচের সড়কও আটকে যাবে অনেকটা। এছাড়া ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে যেসব উড়ালপথ তৈরি করা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোর হেডরুমের নিচের সড়ক বিটুমিনের। এখানকার প্র্যাকটিস অনুযায়ী বছর বছর পিচ ঢালাই করা হয়। পিচ ঢালাই করা হয় আগের পিচের ওপরে। ফলে নিচের সড়কটি ক্রমেই পুরু হয়ে ওপরে চলে আসতে থাকে। এতে হেডরুমের উচ্চতা কমে যায়, যা তুলনামূলক উঁচু যানবাহন চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রশ্ন হলো, উড়ালপথের হেডরুমের উচ্চতা বাড়ানো হবে নাকি যানবাহনের অতিরিক্ত বোঝা পরিবহনের রাশ টেনে ধরা হবে। একদল বিশেষজ্ঞ হেডরুমের উচ্চতা সওজের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটি বাড়ানোর কথা বলছেন। আরেক দল বিশেষজ্ঞ অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই গাড়ি চলাচলকে নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিচ্ছেন। পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো ভার নিয়ে ট্রাক চলে না। নিয়ন্ত্রণের কাজটিই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো করতে পারছে না এবং এর দায়টা পড়ছে সড়ক অবকাঠামোর ওপর। এমন প্রেক্ষাপটে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে হেডরুমের উচ্চতা নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং নিখুঁত নকশা প্রণয়নে আরো সতর্ক হতে হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী উড়ালপথের হেডরুমের উচ্চতা গড়ে দশমিক মিটার। ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, স্পেনের অবকাঠামো নির্মাণে মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় এটি দশমিক ৭০, ডেনমার্কে দশমিক ৬০ এবং যুক্তরাজ্যে দশমিক ১০ মিটার উচ্চতা মেনে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশই সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। মানদণ্ড অনুসরণ করা হলে নির্মাণ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের সড়কপথগুলোয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঠিক থাকলেও স্থানীয় মানদণ্ড অনুযায়ী কম উচ্চতাসম্পন্ন। এখানে উচ্চতার চেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি করছে পরিবহনের অতিরিক্ত বোঝা বহন। দ্বিতল বাসের উচ্চতা দশমিক ২৭ মিটার এবং পণ্যবোঝাই ট্রাকের উচ্চতা মিটারের বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অনেক সময় ট্রাকগুলো দশমিক মিটারের বেশি উচ্চতার পণ্য বহন করে। এতে সড়কের ক্ষতির পাশাপাশি উড়ালপথের হেডরুমে বেধে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে ট্রাফিক বিভাগকে আরো সতর্ক হতে হবে। কোনো ট্রাক বা বাস অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। -সংক্রান্ত মানদণ্ড রয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ দেখা যায় না। বিভিন্ন স্থানে ওয়েব্রিজ থাকলেও সেগুলো অকেজো বা ঘুসের বিনিময়ে সবকিছুর বৈধতা দেয়া হয়। এমন প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা শহরে ধরনের অপরিকল্পিত ত্রুটিপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য দায়ী মূলত দুর্বল পরিকল্পনা কমিশন। সেখানে পর্যাপ্ত পরিকল্পনাবিদ থাকা উচিত ছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরিকল্পনা কমিশনে কোনো পরিকল্পনাবিদ নেই। যখন যে সংস্থাই প্রকল্প নিয়ে যাচ্ছে তারা অনুমোদন করে দিচ্ছে। সেটা ভুল না ঠিক, তা যাচাই করার কেউ নেই। ভুলগুলো কারা করছে, কীভাবে করছে তারও কোনো জবাবদিহি নেই, যা খুবই দুঃখজনক। অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। বাংলাদেশের একটা সুবিধা ছিল, আমরা অনেক দেরিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ শুরু করা হয়েছে। তাই যাচাই-বাছাই করে সঠিক আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নীতিনির্ধারকরা ভুলপথে হাঁটছেন। এতে ঢাকাকে স্থায়ী ভুলের শহর বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, যা টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক নয়। বিদ্যমান বাস্তবতায় হেডরুমের উচ্চতার চিহ্ন প্রদর্শন, অতিরিক্ত উচ্চতার গাড়ি চলাচল বন্ধ এবং উড়ালপথে সব স্থানের উচ্চতা একই রকম রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে ধরনের প্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে মানদণ্ড অনুসরণে আরো সতর্ক হতে হবে।

নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ না করায় দেশের অনেক সেতু, ফ্লাইওভার উড়াল সড়ক নিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটল, মগবাজার ফ্লাইওভারে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন, এমনকি ডানহাতি গাড়ির উপযোগী ফ্লাইওভার নির্মাণের উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। এগুলো মেরামত বা ব্যবহার উপযোগী করতে গিয়ে বাড়তি ব্যয়ও করতে হয়েছে। তথাপি সেগুলো থেকে ইকোনমিক রিটার্নও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বের সব দেশেই অবকাঠামো নির্মাণে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে। সেগুলো তাদের উপযোগী করেই প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সেটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশই ব্যতিক্রম। অনেক জায়গা কোনো স্ট্যান্ডার্ডই নেই, থাকলেও সেটি মানা হয় না। এতে অবকাঠামোয় নানা ত্রুটি থেকে যাচ্ছে, যা দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে পরিবহনের মসৃণ চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে বিপুল ব্যয়ের পরও অর্থনৈতিক রিটার্ন আসছে কম। এক্ষেত্রে যেকোনো অবকাঠামো প্রকল্প নেয়ার আগে সেটি বাংলাদেশের এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে প্রণীত হয়েছে কিনা, তা যাচাই করে দেখা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন