পুরনো হাই-টেক পার্কের অগ্রগতি শ্লথ তবু নতুন নতুন উদ্যোগ

সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া শুধু অবকাঠামো নির্মাণ সুফল বয়ে আনবে না

সারা বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ ক্রমেই দ্রুততর হচ্ছে। বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হলে সে প্রযুক্তিগত বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে। সেই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের যাত্রা, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে রেখে হাই-টেক পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল সময়ের আবর্তে তার অধিকাংশই অর্জিত হয়নি। ফলে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া দেশব্যাপী বিপুল অর্থ ব্যয়ে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পার্ক নির্মাণের আগে বিপুল সম্ভাবনা কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও এগুলোর পেছনে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য ছিল না। ফলে ১২ বছরেও অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে খাতটি সক্ষম হয়নি। বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়নি। এর পেছনে সম্ভাবতা যাচাইয়ের ঘাটতির কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা, প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি খুবই জরুরি, কিন্তু বাংলাদেশে এর চরম ঘাটতি বিদ্যমান। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, অবশিষ্ট হাই-টেক পার্ক নির্মাণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই পর্যাপ্ত গবেষণা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

হাই-টেক পার্ক থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির যে আশা ছিল সরকারের, বাস্তব পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নেই। উদ্যোক্তার অভাবে ঢাকার বাইরের পার্কগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে রয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ জায়গা। ব্যবসা শুরু করেও হাত গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা। দেশের অধিকাংশ আইটি প্রতিষ্ঠান আকারে ছোট। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে ১০-৫০ জন কর্মী কাজ করেন। ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাটেই এমন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব। এসব প্রতিষ্ঠান রাজধানী ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছে না। কারণে প্রযুক্তি পার্কগুলোও কার্যকর হচ্ছে না। তাছাড়া আইটি খাতের গ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলোও ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানী এর আশপাশের এলাকা থেকে আইটি ফার্মের উৎপাদিত পণ্য সেবা বিক্রি করা সহজ। অবস্থায় বিনামূল্যে স্থান দেয়া হলেও কোনো প্রতিষ্ঠান যশোর, সিলেট, চট্টগ্রাম বা রাজশাহী যেতে চাইছে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানকে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যাদের খাত সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। অথচ পুরনোদের জায়গা পেতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধাসহ হাই-টেক যেসব সুবিধা থাকার কথা, সেগুলোরও অভাব রয়েছে হাই-টেক পার্কে। রয়েছে অবকাঠামোগত নানা দুর্বলতা। উদ্যোক্তাদের দাবি, জেলা পর্যায়ে বেসরকারি স্থাপনার ভাড়ার চেয়ে এসব পার্কের স্পেস ভাড়া চার্জ বেশি। ২০১৫ সালে সরকারের ডিজিটাল টাস্কফোর্সের সভায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রযুক্তি পার্ক স্থাপন করে পরবর্তী তিন বছরে মোট এক লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র কয়েক হাজার মানুষের। কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণের বিষয়টিও বাস্তবসম্মত ছিল না। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, অনেক পার্কে নেই ব্যাংকিং লেনদেনের সুবিধাও। পার্কগুলোয় প্রবেশ-প্রস্থানের হাজিরা, স্পেস ভাড়া অন্যান্য সার্ভিস চার্জ লেনদেন করতে হয় কাগজে-কলমে। এসব সমস্যার সমাধান না করে হাই-টেক পার্ক থেকে সুফল আশা করা যায় না। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া হাই-টেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন প্রয়োজন। অবশিষ্ট হাই-টেক পার্ক নির্মাণের আগে সেগুলোর সম্ভাব্যতা পরিমাপ করা জরুরি।

ফিলিপাইনে বেসরকারি উদ্যোগে শতাধিক হাই-টেক পার্ক নির্মিত হয়েছে। সরকার সেখানে শুধু ইউটিলিটি সার্ভিসগুলো নিশ্চিত করেছে। কাজেই আমাদের দেশেও বিত্তবান-বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীরা সে রকম উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। কারণ শুধু সরকারি উদ্যোগ এজন্য যথেষ্ট হবে না, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন। পার্শ্ববর্তী দেশ আইসিটি খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জনের পেছনে দেশটির যথাযথ পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দক্ষ জনবল তৈরি অবকাঠামো নির্মাণ একই সঙ্গে করার ফল আজ তারা পাচ্ছে। শুধু তা- নয়, আইসিটি খাতের জন্য কার্যকর অবকাঠামো ব্যবস্থাও তারা গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিকে প্রযুক্তি বিশ্বের রাজধানী বলা হয়। গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, অ্যাডব, নেটফ্লিক্স, ইন্টেল, এইচপি, ইউটিউবসহ বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর এখানে। কিন্তু উচ্চ শুল্ক এবং আবাসন কার্যালয়ের খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেশি হওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন সিলিকন ভ্যালি ছাড়ছে বা অন্যত্র তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। নানা কারণে অনেক বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান চীন থেকেও তাদের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের হাই-টেক পার্কগুলো এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের গন্তব্য হতে পারে, যদি কর্তৃপক্ষ তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে। এজন্য উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো যেমন দরকার, তেমনি দরকার জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। সরকার চেষ্টাও করছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চার লেন সড়ক, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণসহ অনেক মেগা প্রজেক্টের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পায়রা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বিদ্যুতে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার পরও পরমাণু বিদ্যুৎসহ নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। হাই-টেক পার্কগুলোয় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে সরকার বিশেষ প্রণোদনা সুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১০ বছর কর মওকুফ, পার্ক ডেভেলপারের জন্য ১২ বছর পর্যন্ত কর মওকুফ, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক মওকুফ, প্রতিটি হাই-টেক পার্ককে ওয়্যারহাউজ স্টেশন হিসেবে বিবেচনা করাসহ নানা সুবিধা। এত কিছুর পরও কেন কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় অভাব দক্ষ জনবলের। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গেমিং, ইন্টারনেট অব থিংগস (আইওটি), মেশিন লার্নিং, বিগ ডাটা প্রসেসিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেইন প্রযুক্তির মতো অগ্রসর খাতগুলো নিয়ে কাজ করার মতো জনশক্তির সংকট সীমাহীন ঢাকার বাইরের পার্কগুলোয় সামান্য যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে, এর বেশির ভাগই সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ওয়েবসাইট ডিজাইন, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো তথ্যপ্রযুক্তির মামুলি কাজে জড়িত। সারা দেশে গড়ে তোলা হাই-টেক পার্কগুলোর দুরবস্থার প্রতিনিধিত্বমূলক একটি চিত্র পাওয়া যেতে পারে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের অবস্থা থেকে। পার্ক নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বমানের অবকাঠামো দক্ষ জনশক্তির অভাব, ব্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকা, বেশি স্পেস ভাড়া বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি বিলের চাপে একটি জাপানি একটি দেশী প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যেই যশোর পার্ক থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। বকেয়া বিল আর লোকসানের চাপে কোণঠাসা বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও। দক্ষ জনশক্তির অভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে কাজ নিতে পারছে না স্থানীয় ফার্মগুলো। ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান ইউরোপের ফার্মগুলোর ছেড়ে দেয়া কম মূল্যের কাজগুলো করে এখানকার ফার্মগুলো কোনোভাবে টিকে রয়েছে।

বাংলাদেশে টেকসই হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিং ইকোসিস্টেম নির্মাণের এখনই উপযুক্ত সময়, যেখানে হাই-টেক পার্ক অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে সেটি অবশ্যই যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে নির্মাণ করতে হবে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে দেশব্যাপী হাই-টেক পার্ক স্থাপনের চেয়ে যে কয়েকটি নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোকে কার্যকর করে তুলতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বিদ্যমানগুলো থেকে সুফল না মিললে এক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ে অর্থনৈতিক উপযোগ মিলবে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, পরবর্তীকালে প্রণীত রূপকল্প-২০২১, দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপকল্প-২০৪১, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা-নীতিগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব দলিলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার স্পষ্ট। এও অস্বীকারের উপায় নেই, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে দেখা হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়নে তা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। আউটসোর্সিংসহ ডিজিটালাইজেশনের সুফল মসৃণভাবে সবার কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এখনো কিছু বাধা রয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে নীতিগত পর্যায়ের সদিচ্ছা নিয়ে আমরা সন্দিহান নই; কিন্তু সেই সদিচ্ছা মাঠ পর্যায়ে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, সেদিকে নজর দিতে হবে। অনুপ্রেরণা প্রণোদনার পাশাপাশি উপযুক্ত নজরদারিই পারে লাখো তরুণের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন তথা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া মসৃণ করতে। এক্ষেত্রে হাই-টেক পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর জন্য সেগুলোকে কার্যকর করে তুলতে হবে সর্বাগ্রে। চিহ্নিত করতে হবে কোথায় সম্ভাবনা রয়েছে এবং কোথায় দুর্বলতা রয়েছে। বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে শুধু নতুন নতুন ভবন নির্মাণের মাধ্যমে আইসিটি খাতে বিনিয়োগও বাড়বে না, অর্থনৈতিক সুফলও মিলবে না। এজন্য আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, হাই-টেক পার্ক নির্মাণের আগে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন