রাজনীতিতে সিলেটের প্রভাব এখন ক্ষয়িষ্ণু

আনিকা মাহজাবিন

আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের একজন প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা আবদুস সামাদ আজাদ। দেশের রাজনীতিতে তিনি সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনেও বড় অবদান ছিল তার। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শুধু সংগঠক নয়, নীতিনির্ধারণী ভূমিকায়ও অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অভিজ্ঞ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে সম্মানের পাত্র ছিলেন তিনি।

দেশের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ানদের একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উঠে এসেছিলেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলভুক্ত সুনামগঞ্জ থেকে। ষাটের দশকে ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির মাধ্যমে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তার। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে। স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দীর্ঘ ৫৬ বছর শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তুলেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছিলেন প্রজ্ঞাবান বাগ্মী রাজনীতিবিদ হিসেবে।

গত এক শতকেরও বেশি সময় সিলেট অঞ্চলের অনেক নেতাকে জাতীয় পর্যায়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের অন্যতম হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। ধারা বহাল ছিল চলতি শতকের শুরুর দশকেও। কিন্তু বর্তমানের জাতীয় রাজনীতিতে হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা বলতে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। পর্যবেক্ষক রাজনীতিবিদরাও বলছেন, মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিলেট অঞ্চলের প্রভাব এখন দিন দিন কমে আসছে।

অথচ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের বিকাশের এক উর্বর ভূমি হয়ে উঠেছিল সিলেট। গোটা উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী চিন্তাধারার জনক বলা হয় বিপিনচন্দ্র পালকে। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মতবিরোধের পর স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মতিলাল নেহরুকে সঙ্গে নিয়ে স্বরাজ পার্টি গঠন করেছিলেন। আবার বাল গঙ্গাধর তিলকের হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের বিপক্ষেও শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। বিপিনচন্দ্র পালের জন্ম হয়েছিল হবিগঞ্জে। তার বেড়ে ওঠা রাজনীতির হাতেখড়িও ঘটেছিল বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মাঠে-ঘাটে। 

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আরেক কিংবদন্তি নেতা কমরেড অজয় ভট্টাচার্য ছিলেন পাকিস্তান আমলে সংঘটিত নানকার বিদ্রোহের প্রধান সংগঠক। দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের বাড়ি ছিল সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতায়।

পাকিস্তান আমলেও পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান স্বাধিকার আন্দোলনের প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও এখানকার রাজনীতিবিদরা ছিলেন সামনের সারিতে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর জন্ম সুনামগঞ্জে। রাজনীতিতে যোগ দেয়ার আগে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্ম তার হাত দিয়েই। সেনাবাহিনীতে পরিচিত ছিলেন পাপা টাইগার নামে। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। স্বাধীনতার পরও রাজনীতিতে দীর্ঘদিন সক্রিয় ছিলেন তিনি।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও রাজনীতির ময়দানে একের পর এক সফলতার নজির তৈরি করেছেন সিলেট অঞ্চলের নেতারা। নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন তারা। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতির গুরুভার সামলেছেন সিলেট অঞ্চলের নেতারাই। সরকারি বা বিরোধী দলীয়উভয় ধরনের রাজনীতিতেই অঞ্চল থেকে উঠে আসা নেতারা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সিলেট থেকে উঠে আসা নেতারা এখন আর সেভাবে ঝড় তুলতে পারছেন না। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও অঞ্চলের নেতাদের অংশগ্রহণ দিনে দিনে কমে আসছে। যদিও দেশের বর্তমান মন্ত্রিসভায় সিলেট অঞ্চল থেকে আগত সদস্য রয়েছেন পাঁচজন, যাদের মধ্যে তিনজন মন্ত্রী দুজন প্রতিমন্ত্রী।

বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, এখন সময় বদলে গেছে। সে অযোধ্যাও নেই। সে রামও নেই। সিলেট অঞ্চলের বাঘা বাঘা নেতার অনেকেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা প্রজন্মের নেতা। এখন আধুনিক চিন্তাভাবনা দরকার। আমি নিজেকেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বড় কেউ বলে মনে করি না।

রাজনীতিবিদরা বলছেন, এখন সিলেটের রাজনীতিবিদরা নিজ নিজ দলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে অনেকটাই অনুপস্থিত। নেতাদের সাংগঠনিক দক্ষতা পূর্বসূরিদের মতো নয়। দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের অন্যতম বিএনপিরও এখন একই দশা। দলটিতে এখন সিলেট থেকে আগত উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকে দেখা যায় না, যিনি পূর্বসূরিদের মতো দলের ক্রান্তিকালে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখছেন।

প্রায় তিন দশক ধরে দেশের অর্থনীতির নীতিনির্ধারকের আসনে ছিলেন সিলেট থেকে আগত রাজনীতিবিদরা। নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার নিয়ে এসেছিলেন এম সাইফুর রহমান। মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণকারী রাজনীতিবিদ নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে দেশের কর শুল্ক ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে ফেলেছিলেন। বাণিজ্য খাতে নির্দিষ্ট শুল্কহারের বদলে মূল্যভিত্তিক শুল্কহারের সূচনা হয় তার হাত ধরে। পণ্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও আরো অনেক সংস্কার এনেছেন তিনি। প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদার নীতিগুলোর প্রণয়ন বাস্তবায়ন করে গিয়েছেন বিএনপির নেতা।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে বলে মনে করছেন এম সাইফুর রহমানের ছেলে এম নাসের রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সিলেটের বর্ষীয়ান নেতারা নিজস্ব নেতৃত্বের বলয়ে এবং স্বমহিমায় পরিচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন এটি নেই। আমারও আমার বাবার মতো সক্ষমতা নেই। সিলেটে বড় দুই দলেই এখন তাদের মতো প্রতিভাবান নেতা নেই। বৃহত্তর সিলেটের মানুষের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছে।

নব্বইয়ের দশকেই পূর্বসূরি সাইফুর রহমানের সংস্কার পদক্ষেপগুলোর সপক্ষে শক্ত অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। তার সময়েই অর্থনীতিতে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়ে। প্রচলন হয় বয়স্ক ভাতার। হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কর্মজীবনে কূটনীতিক হিসেবেও বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

রাজনীতিতে সিলেটি নেতাদের প্রভাব কমে আসাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখছেন শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে . রেজা কিবরিয়া। তিনি বলেন, একেক সময় একেক জেলার প্রভাব থাকে। এখন সিলেটের নেই। এখানে তেমন বিশেষ কোনো কারণ নেই। আমার কাছে এটাকে কাকতালীয় মনে হয়।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার বাজেট ঘোষণাকারী অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাড়ি সিলেটে। তার হাত ধরে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল দেশের অর্থনীতি। মূলত আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই জাতীয় রাজনীতিতে সিলেট অঞ্চলের প্রভাব কমে আসে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তার ছোট ভাই . কে আব্দুল মোমেন বর্তমান মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

বর্তমানে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ দুই-একজন ছাড়া সিলেটের প্রভাবশালী বর্ষীয়ান নেতাদের অধিকাংশই এখন প্রয়াত। তাদের প্রস্থানের পর জাতীয় পর্যায়ে দূরের কথা সিলেটের আঞ্চলিক পর্যায়েই এখন বড় ধরনের নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদরা।

হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সপ্তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিলেট অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রভাব কমে আসার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের পর্যবেক্ষণ হলো পদ-পদবির দিক থেকে সিলেটি রাজনীতিবিদদের কোনো কমতি নেই। কিন্তু শাহ এএমএস কিবরিয়াদের মতো নেতা এখন আমি আর দেখছি না। আগে রাজনীতিকে উন্নততর করার জন্য যে নীতি, আদর্শ, ত্যাগ দেখা যেত; এখন সেটা দেখা যায় না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাহাত্তর সালে একাই বিরোধী দল থেকে পার্লামেন্ট কাঁপিয়ে ফেলেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু যে সিদ্ধান্তই নিতেন সুনির্দিষ্টভাবে জিজ্ঞেস করতেন, বিষয়ে সুরঞ্জিতের কী বক্তব্য শুনি। ওই জিনিস কিন্তু এখন আর নেই। রাজনীতির নির্যাস হলো পরমতসহিষ্ণুতা। এখন এটির অভাব রয়েছে।  আমাদের  সিলেটের নেতারা ঐক্যবদ্ধ নন। একজন নেতার বিরুদ্ধে অন্য নেতারা একমত হয়ে যান। তারা সবাই মিলে কাজ করলে আমাদের সিলেটের অর্থনীতি আরো এগিয়ে যাবে।

জাতীয় পর্যায়ে সিলেটি রাজনীতিবিদদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাকে স্বীকার করছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলও। তিনি বলেন, মুহূর্তে আমাদের সিলেটি রাজনীতিবিদদের মধ্যে এক বিরাট শূন্যতা বিরাজ করছে। শূন্যতা সহসা কোনোভাবে পূরণ হবে না। তারা গণমানুষের নেতৃত্ব এবং তেমন সময় পরিবেশের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছেন। এখন অনেক সময় কমিটিতে কলম দিয়ে নাম লিখলেই হয়। আগেকার নেতারা গড়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আগের, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনএসব প্রেক্ষাপট থেকে। তাছাড়া তাদের যে ডেডিকেশন ছিল সেক্ষেত্রেও তাদের ধারেকাছে যাওয়ার মতো কেউ নেই। রাজনীতির বাইরে তাদের আর কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। এখন যারা আছেন অনেকেই ওই জায়গায় নেই।

সিলেটের অন্যতম বাম রাজনীতিক বরুণ রায়। ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। অংশগ্রহণ করেন তেভাগা আন্দোলন, ভাসান-পানি আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সিলেট অঞ্চলের বাম রাজনীতিবিদদের কেউই এখন আর সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই। রাজনীতিতে তাদের অবস্থার জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করেছেন সিলেট সিপিবির নেতারা।

সিলেট সিপিবির বিভাগীয় সমন্বয়ক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হোসেন সুমন বলেছেন, বরুণ রায়রা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে খেটে খাওয়া মানুষদের সহযোগিতা করেছেন। তারা সার্বক্ষণিক রাজনীতি করেছেন। আমাদের বর্তমানের যে প্রজন্ম তাদের মধ্যে সারাক্ষণই রাজনীতি করার মতো লোকের অভাব। আমরা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকি। আমাদের পেশায় সময় দেয়ার পর যে সময়টুকু পাই, সেটুকুই আমরা রাজনীতিতে দিয়ে থাকি। সে হিসেবে আমাদের জনসম্পৃক্ততায় ঘাটতি থেকে যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন