পাঠক মত

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাতাস ও কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের প্রযুক্তিসংক্রান্ত সম্ভাব্যতা যাচাই

ইয়ুথ ওয়াটার ফেলোশিপ প্রোগ্রাম-২০২১ হাউজ অব ভলান্টিয়ার্স এসটেক্স-বুয়েটের সহায়তায় একটি গবেষণা উদ্যোগ। বাংলাদেশে পানি দূষণ এবং পানিসংক্রান্ত নানা সমস্যার প্রেক্ষাপটে এর থেকে উত্তরণে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পানি নিয়ে গবেষণার কাজে উৎসাহিত করতে গবেষণা প্রোগ্রামটি চালু করা হয়েছে। প্রোগ্রামের অধীনে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। সেগুলো থেকে নির্বাচিত দুটি নিবন্ধের অংশবিশেষ নিয়েই আজকের পাঠক মত সাজানো হলো

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে পাহাড়ে পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নেয়। দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলো খাবার পানির জন্য মূলত প্রাকৃতিক ছড়া, ঝিরি কুয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। শুকনো মৌসুমে জায়গাগুলোয় পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে গ্রামবাসীকে বিশেষত নারীদের দুর্গম পাহাড়ি পথে দূর থেকে পায়ে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বান্দরবান জেলার কয়েকশ খাল ঝরনার ওপর স্থানীয়রা পানির জন্য নির্ভর করতেন। কিন্তু উৎসগুলো থেকে আর আগের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বন উজাড়, পার্বত্য অঞ্চলের জলাধারগুলো থেকে পাথর কেটে নেয়ায় মূলত সংকট তৈরি হয়েছে। ভৌগোলিক কারণে সমতলের মতো এখানে প্রকল্প গ্রহণ করে সুপেয় পানির সংকট নিরসন সম্ভব না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাথুরে হওয়ায় এলাকায় গভীর নলকূপ বসানো যায় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইয়ুথ ওয়াটার ফেলোশিপ প্রোগ্রাম-২০২১-এর আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পানি সংকট নিরসনে বাতাস কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের প্রযুক্তি কতটুকু উপযোগী তা পর্যালোচনার জন্য একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে যার মূল বিষয়বস্তু ছিল বাতাস কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের সাশ্রয়ী প্রযুক্তিগুলোর বিশদ পর্যালোচনা, বিশ্বের যেসব জায়গায় সম্পর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে সে সব প্রকল্পের সফলতা ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তা চিহ্নিতকরণ শুষ্ক মৌসুমে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগিতা যাচাইকরণ।

কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের প্রচলিত পদ্ধতি হলো ফগ ক্যাচার পদ্ধতি। ফগ ক্যাচার মূলত তিনটি অংশ দিয়ে গঠিত। ফ্রেম বা কাঠামো, প্লাস্টিকের জাল, সরু পাইপ। স্টিল, বাঁশ কিংবা কাঠ দিয়ে এর ফ্রেম তৈরি করা হয়। ফ্রেমের ভেতর লাগানো হয় প্লাস্টিকের চিকন রশি দিয়ে তৈরি জাল। সমতল থেকে কিছুটা ওপরের দিকে বাতাসের বিপরীত দিকে লম্বা করে জালসহ ফ্রেম স্থাপন করা হয়। পুরো বিষয়টিকে আমাদের দেশের নৌকার পালের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কুয়াশা এসে জালে আটকায়, যা পানির ফোঁটায় রূপান্তরিত হয় পাইপে জমা হয়। ওই পাইপের পানি গিয়ে জমা হয় একটি বড় ট্যাংকে। সেখান থেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী সবাই পানি সংগ্রহ করে। এভাবে একদিনে ২০০-৪০০ লিটার পানি সংগ্রহ করা যায়। শুষ্ক মৌসুমে যখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কম, সেখানে পদ্ধতি কার্যকর। ফগ ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম নামে পরিচিত প্রযুক্তিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, চিলিপেরু, একুয়েডর, মেক্সিকো, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, স্পেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মরক্কো, ওমানসৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, নেপালসহ অনেক দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে পানি সংগ্রহের প্রভাবে কৃষিকাজেও নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থাপিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফগ ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম ব্যবহার করে কুয়াশাকে পানিতে পরিণত করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মরক্কোর একটি বেসরকারি সংস্থা। প্রকল্পের ফলে নারীদের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় এসেছে আমূল পরিবর্তন।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের প্রযুক্তির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ে কুয়াশার পরিমাণও তুলনামূলক বেশি থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাতাসের যে আর্দ্রতা রয়েছে সেটিও কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের জন্য উপযোগী। তাই মাঠ পর্যায়ে গবেষণার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নিরাপদ স্বল্পমূল্যের খাবার পানিতে সবার সর্বজনীন সমতাভিত্তিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য পূরণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পানি সংকট নিরসনেও আমাদের মনোযোগী এবং বিকল্প উৎস সন্ধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  

 

সৌমিক দাশ সৌম্য: ফেলো ইয়ুথ ওয়াটার ফেলোশিপ প্রোগ্রাম-২০২১ শিক্ষার্থী, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন