ক্ল্যাসিক রোমান্সের নান্দনিক উপস্থাপন

মাহমুদুর রহমান

‘সীতা রামাম’-এ দুলকার সালমান ও ম্রুনাল ঠাকুরের রসায়ন

৬০০ রুপি বেতনের এক সৈনিকের জন্য নিজের সব ছেড়ে আসা মহারানী, জন্মের জন্য চিরবিদায়, প্রিন্সেস নূর জাহান।

বহুদিন পর ভারতের কোনো সিনেমায় এমন চিঠি আর সে চিঠির সঙ্গে অসামান্য দৃশ্যায়ন দেখা গেল। হানু রাঘবপুরীর তেলেগু সিনেমা সীতা রামাম-এর এই ছিল ক্লাইম্যাক্স। সিনেমা যদিও তখনো শেষ নয় কিন্তু দর্শকে বিহ্বল করার জন্য যথেষ্ঠ। প্রেমের গল্প নিয়ে সিনেমা তো অনেক তৈরি হয়, কিন্তু দর্শকের হূদয় স্পর্শ করার মতো সিনেমা তেমন দেখা যায়নি। ভারতের ক্ল্যাসিক লাভ স্টোরি ধারার সিনেমা সীতা রামাম দর্শককে সে অনুভূতি দিল। গল্পের পাশাপাশি দুলকার সালমান, ম্রুনাল ঠাকুরের রসায়ন তাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সীতা রামামের গল্পটা ভালোবাসার। এক একাকী সৈনিক রাম। কাশ্মীরে তার পোস্টিং। একটি অভিযানে কাশ্মীরিদের বাঁচানোর পর রেডিও সাক্ষাত্কারে রাম জানান যে তিনি অনাথ। পৃথিবীতে তিনি একা। আর সেই থেকেই রামের কাছে আসে অসংখ্য চিঠি। বস্তাভরা (আক্ষরিক অর্থেই) চিঠির মাঝে একটি চিঠি সীতা মহালক্ষ্মীর। সীতা নিজেকে রামের সীতা বলেই উপস্থাপন করে। আর তারপর না দেখা সেই প্রেয়সীর সঙ্গে চিঠিতে তৈরি হয় রামের প্রেম। রাম তাকে খুঁজেও বের করে কিন্তু সীতা কেন যেন ধরা দিতে চায় না রামকে। প্রেমের পুরনো সেই গল্প। কিন্তু সেখানে হানু একটা বা একাধিক ভিন্নতা রেখেছেন। সেটা উপস্থাপনে।

ভারতের নানা সিনেমায় কাশ্মীর এসেছে। সিনেমায় কাশ্মীরের উপস্থাপন কিছুটা নির্দিষ্ট। বরফঘেরা পাহাড়, আর্মি ক্যাম্পের পাশে কাশ্মীরের ছোট ছোট গ্রাম। দর্শকরা অনেকে বলছেন কাশ্মীর দেখা গিয়েছে সিনেমায়। তবে সত্যিকার কাশ্মীর দেখা যায়নি, যেমনটা গিয়েছিল বিশাল ভরদ্বাজের হায়দার, বিধু বিনোদের শিকারা বা অভিষেক কাপুরের ফিতুরে। মণি রত্মমের রোজা তোলাই রইল। সীতা রামামে বরং বলা যায় ষাট আশির দশকের উপস্থাপনাটা ভালো হলো। তবে সেটাও এলাকা কিংবা ইতিহাস নয়, পাত্রপাত্রীর পোশাক, চলনবলনে। রেডিও থেকে ট্রেনের কামরা এমনকি ছাতার ব্যবহারেও।

সিনেমায় মূল গল্পের পাশে আছে আরো দুটি কিংবা তিনটি গল্প। কাশ্মীর বা ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের গল্পটা ভারতে সবসময় একপেশেই উপস্থাপন করা হবে। এটা মেনে নিয়ে সিনেমার দিকে নজর দিলে কয়েকটা জিনিস পাই। প্রথমত আফরিনের (রাশমিকা মান্দানা) মাধ্যমে প্রতিবাদের একটা কণ্ঠ। শচীন খেড়কারের তারিক চরিত্রটির মধ্য দিয়ে একজন মানবতাবাদীর চরিত্র রাখা হয়েছে। পাকিস্তানি মেজর তারিক শেষ অবধি রামের চিঠি নূর জাহানের কাছে পাঠানোর দায়িত্বটা নেন। এমনকি বন্দি বিষ্ণু রামকে তিনি মুক্ত করার চেষ্টাও করেছিলেন।

মূল গল্প অর্থাৎ রাম সীতার প্রেমের উপস্থাপন চিত্রায়ণ সিনেমার প্রাণ। সেখানে দুলকারের অভিনয় একজন তরুণ প্রেমিকের মনের অবস্থা যেভাবে স্পষ্ট করে তা ভারতীয় সিনেমায় অনেক দিন দেখা যায়নি। ম্রুনালের খামখেয়ালি, ধরা না দেয়ার লুকোচুরির পাশে দৃঢ়চেতা একটা চরিত্র দেখানো হয়েছে সিনেমায়। সেখানে ম্রুনাল অনবদ্য। আর পুরো বিষয়টা সিনেমায় তুলে ধরার জন্য ছিল চমত্কার সেট ডিজাইন। বৃষ্টি হোক, কাশ্মীরের বরফ কিংবা আয়না দিয়ে ভরা একটা কামরাঅন্তত সাত-আটটা সিকোয়েন্স সিনেমায় আছে, যেখানে দর্শক সিনেমা পজ করে তাকিয়ে থাকতে চাইবে। একটি সিকোয়েন্সে পায়ের তলায় অজান্তে রঙ লেগে সীতা রামের চলার দৃশ্যটি চমত্কারভাবে ক্যামেরায় ধরা হয়েছে।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে শুরুতে রাশমিকা ঝড়ের মতো আসেন আর দর্শক ভাবতে বাধ্য হবে আফরিনই সিনেমার মূল চরিত্র। কিন্তু সৈনিক (লেফটেন্যান্ট) রামের ইন্ট্রোডাকশন সিন অনেক কিছু বদলে দেয়। মজার ব্যাপার, সিনেমায় সীতার আগমন অনেকটা দেরিতে। প্রায় ৪৮ মিনিট পেরিয়ে সীতা চরিত্রে ম্রুনালকে দেখা যায়। কিন্তু তারপর রাম আর সীতার থেকে চোখ ফেরানো যায়নি, সে তারা একত্রে থাকুন বা আলাদা। সিনেমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক রাম চরিত্রে দুলকার যখন সেনাবাহিনীতে থাকেন তখন তার এক রূপ, সীতার সঙ্গে অন্য রূপ। একটা সৈনিকের, আরেকটি প্রেমিকের। সীতা বা নূর জাহানের ক্ষেত্রেও তাই। অভিনয়ের এই ছিল গুণ। পার্শ্ব অভিনেতাদের ক্ষেত্রে বিষ্ণু চরিত্রে সুমন্ত, বালাজি চরিত্রে তরুণ ভাস্কর ভালো কাজ করেছেন। ব্রিগেডিয়ার জোশীর চরিত্রে ক্যামিও করেছেন প্রকাশ রাজ, নূর জাহানের ভাইয়ের চরিত্রে ছিলেন যীশু সেনগুপ্ত। মেজর সেলভার চরিত্রে পরিচালক গৌতম বাসুদেব মেননের অভিনয় বেশি নজর কাড়ে।

সীতা রামাম সিনেমার গল্প বা গল্পের ধারাটি পুরনো। বিষ্ণু বর্ধনের ২০২১ সালের শেরশাহ প্রায় একই ধারার সিনেমা। ১৯৬৯ সালে শক্তি সামন্ত পরিচালিত আরাধনা আগে পরেও এমন সিনেমা কম হয়নি। এমনকি যশ চোপড়ার বীর-যারা সঙ্গে সীতা-রামামকে মেলানো যায় খুব সহজে। স্কোয়াড্রন লিডার বীর প্রতাপ সিংয়ের বন্দিত্ব, যারার প্রতি প্রেম এমনকি কোর্টরুমে শাহরুখ খানের কবিতার সঙ্গে রামের শেষ চিঠির কোনো না কোনো মিল থেকেই যায়। কিন্তু সে মিলগুলো দর্শক বিবেচনায় নেয়নি কিংবা নতুন প্রজন্মের দর্শদের জন্য সিনেমার ধারাও নতুন। দর্শক সাইকোলজির একটা দিক ধরে বলা যায়, সমাজে সম্পর্ক ভেঙে পড়ার যুগে নিবেদনের গল্পগুলোর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কিংবা, হাফ গার্লফ্রেন্ড, হিরোপান্তি মতো রোমান্টিক সিনেমা আর কেজিএফ, পুষ্পা মতো অ্যাকশন দেখে একঘেয়ে হয়ে যাওয়া দর্শকরা সুন্দর উপস্থাপনে একটা নিটোল প্রেমের গল্প দেখতে চেয়েছিলেন। সীতা রামাম সেখানেই দর্শককে গল্পে সংযুক্ত করতে পারল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন