বাংলাদেশে ব্যবসায়িক কৌশল নতুন করে সাজাচ্ছে আদানি গ্রুপ

আবু তাহের

বাংলাদেশে বৃহদায়তনে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে ভারতের আদানি গ্রুপ। এজন্য ব্যবসার কৌশলই বদলে ফেলছে ভারতের শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির মালিকানাধীন কনগ্লোমারেটটি। আদানি গ্রুপ এখন উচ্চমূল্যের পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক দামেই পণ্য সেবা সরবরাহের পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় আদানি গ্রুপের নির্মীয়মাণ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে অস্ট্রেলিয়ায় কনগ্লোমারেটটির নিজস্ব পরিচালনাধীন খনি থেকে কয়লা সরবরাহের কাজও শুরু হয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা থেকেই আদানির মূল্য নির্ধারণ কৌশলে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়াতে বা সমালোচিত হতে চাইছে না কনগ্লোমারেটটি। এরই মধ্যে বাংলাদেশকেন্দ্রিক বৃহদায়তনের কয়েকটি বিনিয়োগ প্রকল্পও হাতে নিয়েছে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির মালিকানাধীন কনগ্লোমারেটটি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চাইছে। বিশেষ করে রামপাল পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে আদানি গ্রুপের।

গড্ডায় আদানি পাওয়ারের নির্মীয়মাণ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। প্রকল্পের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর ঘোষণা দিয়েছে আদানি গ্রুপ। বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রতিষ্ঠানটি এখন পায়রা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে চাইছে। এজন্য বৃহদায়তনের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয়ের চেয়েও কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা ভাবা হচ্ছে।

পটুয়াখালীর পায়রায় বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) নিয়ন্ত্রণাধীন হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন উৎপাদনে রয়েছে। কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি খরচ পড়ছে টাকা ৪১ পয়সা। একই সক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রেও ইউনিটপ্রতি ব্যয় প্রায় একই রকম থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অন্যদিকে আদানি পাওয়ারের বাংলাদেশে রফতানীকৃত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়াতে পারে বলে জানা গিয়েছে।

তবে বিশ্ববাজারে কয়লার দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের সম্ভাব্যতা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ। আবার ভিন্নমত পোষণ করে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, আদানি গ্রুপের পক্ষে চাইলে বাংলাদেশে সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব। কনগ্লোমারেটটির হাতে জ্বালানি সরবরাহ, বন্দর ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ অবকাঠামোসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে। চাইলেই ব্যবসায়িক স্বার্থে ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আদানি গ্রুপের পক্ষে সম্ভব।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক . তামিম বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, আদানি পায়রা রামপালের চেয়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে সেটি ভালো একটি দিক হবে। প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ সরবরাহের সে সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তবে এটি তারা কী কারণে দেবে বা ভবিষ্যৎ বৃহৎ কোনো বিনিয়োগ স্বার্থে যদি এটা করে থাকে, সেটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। তবে সেজন্য ভারতে তাদের খাতে বিনিয়োগের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে হবে।

গড্ডায় বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ কমাতে মূলত জ্বালানি হিসেবে কয়লার আমদানি ব্যয় হ্রাসের ওপর জোর দিচ্ছে আদানি গ্রুপ। এজন্য কয়লা আমদানিতে প্রায় দুই লাখ টন ধারণক্ষমতার জাহাজ ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কয়লা সরবরাহ হবে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে আদানি পরিচালনাধীন কারমাইকেল কোল মাইন থেকে। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার প্রথম চালান ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। শিগগিরই তা ওড়িশার ধামরা বন্দরে এসে পৌঁছার কথা রয়েছে। সেখান থেকে রেলে করে কয়লা সরাসরি গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছাবে বলে জানা গিয়েছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, নিজস্ব খনি থেকে বড় জাহাজে করে কয়লা আমদানি করবে আদানি। ফলে তাদের খরচ কম হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ কত টাকা পড়তে পারে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি বিপিডিবির ওই কর্মকর্তা।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, কয়লা বা আমদানীকৃত গ্যাসের কোনোটিতেই উৎপাদন সাশ্রয় করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। আদানি গ্রুপের পরিকল্পনা সফল হলে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুৎই এখন তুলনামূলক সাশ্রয়ী বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি সোসাইটির (বিইএস) উপস্থাপিত এক প্রবন্ধে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের (সাময়িক) তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, দেশে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির খরচ পড়েছে ৩৬ টাকা ৬০ পয়সা। ফার্নেস অয়েল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি ব্যয় ১৭ টাকা ১৮ পয়সা। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে খরচ দাঁড়ায় ১৩ টাকা ৯৬ পয়সায়। সবচেয়ে কম খরচ হয় কয়লাবিদ্যুতে, ১৩ টাকা ২২ পয়সা। এর বিপরীতে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি খরচ দাঁড়ায় টাকা ৪৫ পয়সায়।

বিশ্বজুড়ে আদানি গ্রুপের বন্দর ব্যবস্থাপনা, কয়লা উৎপাদন কয়লার ব্যবসা রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন সঞ্চালন, গ্যাস সরবরাহ, সড়ক রেলপথ নির্মাণ, প্রতিরক্ষা মহাকাশ সরঞ্জাম উৎপাদন, বিমানবন্দর পরিচালন ব্যবস্থাপনা, আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন, আবাসন, ভোজ্যতেল, খাদ্যপণ্যসহ নানা খাতেও বিনিয়োগ রয়েছে কনগ্লোমারেটটির।

বাংলাদেশেও এরই মধ্যে নানা খাতে বিনিয়োগ করেছে আদানি গ্রুপ। ভোজ্যতেলের বাজারে মোড়কজাত সয়াবিন তেলেও বিনিয়োগ রয়েছে কনগ্লোমারেটটির। বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের সয়াবিন তেল ব্র্যান্ড রূপচাঁদার যৌথ মালিকানায় রয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ।

বর্তমানে বাংলাদেশে আরো বড় পরিসরে বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে আদানি গ্রুপ। বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চট্টগ্র্রামের মিরসরাইয়ে একটি বিশেষ ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির চুক্তি করে আদানি গ্রুপের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আদানি পোর্টস। অর্থনৈতিক অঞ্চলটির উৎপাদন বাণিজ্যিক কার্যক্রমে প্রধানত ভারতীয় কোম্পানির পণ্যকেই প্রাধান্য দেয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময়ে তার সঙ্গে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি দেখা করেন। ওই সময় তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় ব্যবসায়িক স্বার্থ বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন