লিভার ফেইলিউর রোধে ফ্যাটি লিভার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

ডা. মো. শাহিনুল আলম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের অধ্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে  লিভারের জটিলতায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কাজ করছেন তিনি। লিভার ফেইলিউরের ভয়াবহতা, চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন চিকিৎসক। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

লিভার ফেইলিউর কতটা ভয়াবহ রোগ?

লিভারের কার্যক্ষমতা যখন কমে যায় অথবা শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী যখনই এটা কাজ করতে পারে না তখনই এটাকে লিভার ফেইলিউর বলা হয়। একে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এক. আকস্মিক ফেইলিউর, দুই. দীর্ঘমেয়াদি ফেইলিউর, তিন. দীর্ঘমেয়াদি আকস্মিক ফেইলিউর। আর ভয়াবহের মধ্যে যদি আমরা ভাগ করি তাহলে আকস্মিক ফেইলিউর অত্যন্ত মারাত্মক। উন্নত বিশ্বে এতে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ। আমাদের দেশেও রকম। আর দীর্ঘমেয়াদি লিভার ফেইলিউর আক্রান্তদের মৃত্যুর ঝুঁকি দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৬ শতাংশ।

লিভার ফেইলিউরের কোন ধরনে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি?

দীর্ঘমেয়াদি লিভার ফেইলিউরে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। লিভার সিরোসিস থেকে যে ফেইলিউরটা হয় এটা হলো দীর্ঘমেয়াদি লিভার ফেইলিউর। সংখ্যার দিক থেকে এটাতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।

এটা বেশি হওয়ার কারণ কী বলে মনে করছেন?

দেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের কারণে রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আগে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের কারণে বেশি ছিল। এখন ফ্যাটি লিভারের কারণে দীর্ঘমেয়াদি লিভার ফেইলিউরের সংখ্যা বেশি। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের পরিমাণ কমে আসছে। আর ফ্যাটি লিভারের কারণে এটা বাড়ছে। আমাদের দেশে কম কিন্তু অন্যান্য দেশে অ্যালকোহলের কারণে দীর্ঘমেয়াদি লিভার ফেইলিউরের সংখ্যা বাড়ছে।

বয়স ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করলে এটা কাদের মধ্যে বেশি দেখা দিচ্ছে?

সাধারণত মধ্য বয়স বা বেশি বয়সীদেরই এটা বেশি হয়ে থাকে। তীব্র হেপাটাইটিস বি বা সি আগে লিভার সিরোসিস করবে। তার পরই লিভার ফেইলিউর করবে। আর যেটা আকস্মিক ফেইলিউর এটা কম বয়সী যুবকদের বেশি হয়ে থাকে। এটা সাধারণত তীব্র ভাইরাল হেপাটাইটিস বা যাদের আকস্মিক ভাইরাল হেপাটাইটিস থাকে তাদের বেশি হয়। বিশেষত গর্ভবতী মায়েদের ভাইরাস হলে ফেইলিউর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ৮০ ভাগ।

বাংলাদেশে লিভার রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কত রয়েছে?

নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এখন হয়তো দেশে প্রায় সাড়ে কোটি মানুষ লিভারে আক্রান্ত রয়েছে এবং কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত। তাহলে প্রায় সাড়ে কোটি মানুষ কোনো না কোনো লিভার রোগে আক্রান্ত রয়েছে। তবে ফ্যাটি লিভার থেকে কোটি মানুষ তীব্র লিভারে আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে। সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আগে বিএসএমএমইউতে বহির্বিভাগে ৭০ জন রোগী আসত, এখন আসে ২৭০ জন।

কোন ধরনের জীবনাচরণের কারণে বেশি হচ্ছে রোগ?

অ্যালকোহল সেবন, দূষিত পানি খাদ্য, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিস কমে যাওয়া, স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং ফ্যাটি লিভারের কারণে রোগের ভয়াবহতা বাড়ছে। এগুলো থাকলে দীর্ঘমেয়াদি লিভার ফেইলিউর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

রোগটি প্রতিরোধে আগে থেকেই কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে?

আকস্মিক লিভার ফেইলিউর মোকাবেলায় বিশুদ্ধ পানি বা খাদ্য গ্রহণ, হেপাটাইটিস বি সি ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ, ফ্যাটি লিভার নিয়ন্ত্রণ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি লিভার ফেইলিউরের ঝুঁকি কমানো যাবে। খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে হাই ক্যালরি যেমন চিনি, মিষ্টি বা চকলেট, আইসক্রিম জাতীয় খাবারগুলো পরিহার করতে হবে। ফাস্টফুড বা সফট ড্রিংসগুলো গ্রহণে দীর্ঘমেয়াদি লিভার সিরোসিস বা লিভার ফেইলিউর বাড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি শুরু হয়েছে বুফে কালচার। এতে রেড মিটের চেয়ে চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি থাকে। অনেকে এতে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পাকস্থলীতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ফ্যাট ট্যাক্স আরোপের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

দেশে রোগে আক্রান্ত রোগীরা কত ভাগ চিকিৎসার আওতায় আসছে?

একটা মানুষের লিভার বা কিডনি ফেইলিউর হলে একটা পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। এটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার কারণে অনেক ব্যয়বহুল। সাধারণত অসুস্থ হলেই তার ৪০ ভাগ মানুষ চিকিৎসার আওতায় আসে না।

আমাদের দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের সুবিধা মুহূর্তে নেই কেন?

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ১৯৯৯ সালে প্রথম প্রতিস্থাপন শুরু করে। বর্তমানে তাদের ১০০টার বেশি সেন্টারে প্রতিস্থাপন হয়। বাংলাদেশে সরকারের পাশাপাশি পেশাজীবী, বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চবিত্তদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের হাজার হাজার লোকের প্রতিস্থাপনের দরকার হবে। এটা শুধু সরকারি উদ্যোগে হবে না। অবিলম্বে ট্রান্সপ্লান্ট শুরু হওয়া উচিত। তবে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে। দ্রুতই আবার শুরু হবে।

লিভার ফেইলিউর চিকিৎসায় আর কী কী সংকট রয়েছে দেশে?

দেশে এত পরিমাণ লিভার ফেইলিউরের রোগী রয়েছে কিন্তু কোথাও এর জন্য আলাদা আইসিইউ নেই। মেডিকেল কলেজগুলোর লিভার বিভাগ আছে। সেখানে লিভারের আলাদা কেয়ার বা ইউনিট নেই। ফলে এসব রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আর কী কী সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

অচিরেই ঢাকায় একটা লিভার ইনস্টিটিউট হওয়া প্রয়োজন। দেশে হাজার লিভার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। আছেন মাত্র ১২৭ থেকে ১৩০ জন। জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে লিভার বিভাগ খোলা প্রয়োজন। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে রোগে আক্রান্ত রোগীরা পূর্ণ মাত্রায় চিকিৎসা পাবে বলে আশা করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন