দৃষ্টি হারাতে থাকা চার সন্তানকে নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ

বণিক বার্তা অনলাইন

অদ্ভুত অসুখ হয়েছে আপনার কিংবা কোনো প্রিয়জনের। ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলবেন দৃষ্টিশক্তি। চিকিৎসক যদি এমন ভবিষ্যদ্বাণী শোনায়, কী করবেন? হয়তো বলবেন, জগতের সুন্দর বিষয়গুলো শেষবারের মতো দেখে নিতে চাই। ঠিক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এডিথ লামে ও সেবাস্টিয়ান পিলেটিয়ার দম্পতি। তবে তারা নন, দৃঙ্গি হারাচ্ছে তাদের সন্তানরা।

চার সন্তান নিয়ে হাসি-আনন্দে ভরা ছিল এ কানাডিয়ান জুটির সংসার। কিন্তু সবকিছু বিষাদে পরিণত হলো অল্প দিনের ব্যবধানে।

এডিথ ও সেবাস্টিয়ানের বিয়ের বয়স ১২ বছর। তাদের চার সন্তানই রেটিনিটিস পিগমেন্টোসা (আরপি) ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই রোগে ক্রমে ভেঙে যেতে থাকে রেটিনা। রোগী ক্রমশ হয়ে পড়ে দৃষ্টিশক্তিহীন।

দুর্লভ জেনেটিক রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায় শৈশবেই। এখনো কোন প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। এডিথ ও সেবাস্টিয়ানের ঘরে সর্বপ্রথম ধরা পড়ে তাদের তিন বছর বয়সী মেয়ে মিয়ার চোখে। এরপর একই লক্ষণ দেখা দেয় দুই ছেলে কলিন ও লরেন্টের। বাকি থাকে না বড় ছেলে লিও। তাদের বয়সই বা কত? বর্তমানে লিও ৯, কলিন ৭ ও লরেন্টের বয়স ৫ বছর।

স্বভাবতই সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠেন এ দম্পতি। আলোহীন ভবিষ্যৎ সহজ করতে তাদের শেখাতে লাগলেন নানা রকম কৌশল। ওই সময় বিশেষঞ্জের একটা পরামর্শ নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। দৃষ্টিশক্তি তো ফিরে পাওয়া যাবে না, তবে ভিজুয়্যাল মেমোরি বাড়ানো যাবে। আগেই দেখে বাড়িয়ে নেয়া যাবে অভিজ্ঞতা। এডিথ সন্তানদের জন্য নতুন একটা পথ খুঁজে পেলেন। স্বামীকে নিয়ে সাজালেন পরিকল্পনা। এক বছর ঘুরবেন পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে।

বিয়ের পর এডিথ ও সেবাস্টিয়ান অনেক ভ্রমণ করেছেন। সঙ্গী করেছিলেন সন্তানদেরও, কিন্তু এখনকার অবস্থা সম্পূর্ণ। লম্বা সময়ের জন্য সবকিছু গুছিয়ে নিতে হয়েছে তাদের। কেবল সুন্দর দৃশ্য নয়, সন্তানদের পরিচয় করাতে হবে বৈচিত্র্য মানুষ ও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে। চোখের আলো নিভে যাবার আগেই।

সেবাস্টিয়ান একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থবিভাগে কাজ করতেন আর এডিথ স্বাস্থ্যসেবায়। ভ্রমণের জন্য টাকা জমিয়েছেন তারা। সেবাস্টিয়ানের কোম্পানিও কিছুটা সাহায্য করেছে।

গত ২০২০ সালের জুলাই মাসেই বের হবার কথা ছিল ছয় সদস্যের এ পরিবারের। পরিকল্পনার শুরুতে ছিল রাশিয়া ও চীন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবে পিছিয়ে যায় সব পরিকল্পনা। শেষ অব্দি গত মার্চে আসে সেই সুযোগ। সন্তানদের নিয়ে এক বছরের জন্য মন্ট্রিয়ল ত্যাগ করেন এই দম্পতি। এবার অবশ্য তেমন পরিকল্পনা নেয়নি তারা। সফরের মধ্যেই নতুন করে যোগ হবে অনেককিছু। রওনা হবার আগে মিয়া ঘোড়ার সওয়ার হয়ে চলতে চেয়েছিল, লরেন্ট জুস খেতে চেয়েছিল উটের পিঠে বসে। সেটা পূরণ করা হয়েছে আগে।

দিন কয়েকের মধ্যেই এডিথ ও সেবাস্টিয়ান নামিবিয়ায় যাত্রা করেন। সেখানে বাচ্চারা দেখে হাতি, জেব্রা ও জিরাফসহ কত কী। তারপর জাম্বিয়া হয়ে তাঞ্জানিয়া। সেখান থেকে সরাসরি চলে যান তুরস্কে। ১ মাস কাটিয়ে যান মঙ্গোলিয়া এবং তারপর ইন্দোনেশিয়া। এভাবে তাদের ভ্রমণ চলেছে দেশ থেকে দেশে, মহাদেশ থেকে মহাদেশে।

চলার পথে দৃশ্যকে গুরুত্ব দেন এডিথ ও সেবাস্টিয়ান। এ ভ্রমণে তারা সঙ্গী করেছেন বিশ্বের হাজার হাজার মানুষকে। নিজেদের সফরনামা ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করে ভাগাভাগি করছেন অনুভূতি। 

এডিথ ও সেবাস্টিয়ান স্বীকার করেন, যতই কিছু দেখুন না কেন, তারা  সন্তানদের রোগের কথা ভুলতে পারেন না। তা সত্ত্বেও তারা  এই মুহূর্তে বেঁচে থাকা ও ইতিবাচক বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেন।

তারা জানেন না, ঠিক কোন সময় থেকে বাচ্চারা দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকবে। ততদিন পর্যন্ত তাদের জীবন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করে দিতে যান। এ কয়েক মাসে মিয়া, লিও, লরেন্ট ও কলিন প্রতি মুহূর্তে বাঁচতে শিখেছে। যা তাদের আগামী দিনেও বাঁচিয়ে রাখবে।

বাবা-মা হিসেবে সেবাস্টিয়ান ও এডিথ নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে অপেক্ষা করছেন কোন মিরাকলের। আগামী মার্চে তারা বাড়ি ফিরবেন। ততদিনে বা আরো পরে বিজ্ঞান কি এমন কিছু আবিষ্কার করতে পারবে, প্রিয় সন্তানরা দৃষ্টিশক্তি হারাবে না। সেটুকু না ঘটলেও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। সন্তানদের এমন পৃথিবীতে রেখে যাচ্ছেন, যেখানে চোখের আলো না থাকলেও প্রতি মুহূর্ত তারা উপভোগ করবে।     

সিএনএন অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন