শারীরিক প্রতিবন্ধিতা সারাতে ফিজিওথেরাপি

ফখরুল ইসলাম

ফিজিওথেরাপি এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যা মূলত সচলতার বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে মানুষের শারীরিক কিছু সমস্যার সমাধান করে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে চলাচলে অসাড়তা, শরীরের নির্দিষ্ট অংশের ব্যথা, মাংসপেশিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সঠিকভাবে কাজ না করা, স্নায়বিক সমস্যা ইত্যাদি। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে একজন মানুষের শরীর সচল কর্মক্ষম রাখতে সহায়তা করে ফিজিওথেরাপি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময়ে ফিজিওথেরাপি একটি স্বীকৃত, কার্যকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন চিকিৎসা পদ্ধতি। হাড় মাংসপেশির ক্ষয়, আঘাতজনিত ব্যথা, প্যারালাইসিস, সেরিব্রাল পালসি, স্ট্রোক, অস্ত্রোপচার-পরবর্তী কিছু সমস্যাসহ অটিজম আক্রান্তদের চিকিৎসায়ও ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা দশমিক ২৮ শতাংশ। এদের বড় একটি অংশ হাড় মাংসপেশি ক্ষয় রোগে ভুগছে। আবার দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন আঘাতের কারণে প্রতিদিনই প্রতিবন্ধিতার শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ। তাদের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক রোগ বা সমস্যা আছে যেগুলো কেবল ওষুধ বা অস্ত্রোপচারে ভালো হয় না। সমন্বিত চিকিৎসার অংশ হিসেবে কিছু রোগে ফিজিওথেরাপিরও প্রয়োজন হয়।

বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. তছলিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ফিজিওথেরাপি হলো এক ধরনের টিমওয়ার্ক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বড় অংশ হলো রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসন। এক্ষেত্রে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হলেন দলনেতা। প্রক্রিয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীকে ব্যায়াম করান। রোগীর দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মগুলো কীভাবে করা হবে তার জন্য ওকুপেশনাল থেরাপি দেয়া হয়। টিমে সোশ্যাল ওয়ার্কার, রিহ্যাবিলিটেশন নার্সও রয়েছে। যেহেতু পুনর্বাসন প্রক্রিয়া একটি সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি, সে কারণে আমরা চাই পুরো দেশে এটি ছড়িয়ে দিতে।

রোগের ধরন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপির চিকিৎসা পদ্ধতিও বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি, জেরিয়াট্রিক, অর্থোপেডিক, পেডিয়াট্রিক, স্নায়বিক, কার্ডিওভাসকুলার ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি।

বিশ্বে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সূচনা অনেক পুরনো হলেও আধুনিক পদ্ধতির শুরু হয় ১৮৯৪ সালে। ব্যবস্থার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। যেমন ম্যানুয়াল থেরাপি, ম্যানিপুলেটিভ থেরাপি, এক্সারসাইজ থেরাপি, হাইড্রোথেরাপি, ইলেকট্রোথেরাপি। বাংলাদেশে ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে মূলত ১৯৭৩ সালে। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের (এমবিবিএস বিডিএস একই অনুষদের অধিভুক্ত) অধীনে তৎকালীন আরআইএইচডিতে (বর্তমানে নিটোর) ফিজিওথেরাপির ওপর স্নাতক ডিগ্রি চালু করা হয়। একই সঙ্গে রোগীদের চিকিৎসাসেবাও দেয়া শুরু হয়।

বাংলাদেশসহ বিশ্বে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিজিওথেরাপি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় ৫২ কোটি মানুষ অস্টিওআর্থ্রাইটিস রোগে ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ১০ জনে একজনের কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের মতে, বাংলাদেশে অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ভুগছে দশমিক শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশের খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দেশে কোটি মানুষের ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের ২০০৯ সালে সবশেষ সমীক্ষা করেছিল। সেখানে উঠে আসে যে দেশে দৈনিক গড়ে প্রায় ৯০ হাজার মানুষের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন। সে হিসেবে সময়ের ব্যবধানে সংখ্যা বর্তমানে আরো বেড়ে যাওয়ার কথা। অথচ প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পায় না। আবার অনেকেই অপচিকিৎসার শিকার হয়।

ফিজিওথেরাপিস্টদের সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ফিজিওথেরাপি আধুনিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা স্বতন্ত্র চিকিৎসা ব্যবস্থা। যেখানে বিভিন্ন ধরনের বাত ব্যথা, প্যারালাইসিস, প্রতিবন্ধী প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তির সমস্যার সমাধান এবং প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করে স্বাস্থ্যের উন্নতি করা যায়। যারা কাজে সহায়তা করেন তাদের বলা হয় ফিজিওথেরাপিস্ট।

বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন-২০১৮-তে বলা হয়েছে, ফিজিওথেরাপিস্ট বা রিহ্যাবিলিটেশন প্র্যাকটিশনার হতে হলে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের একাডেমিক কোর্স এবং এক বছরের বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপসহ মোট পাঁচ বছর মেয়াদি ডিগ্রি থাকতে হবে।

দেশে এখনো সরকারিভাবে ফিজিওথেরাপি সেবা অপ্রতুল। ফলে বেসরকারিভাবেই চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানটি হলো ঢাকার সাভারে অবস্থিত সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজ? (সিআরপি) প্রতিষ্ঠানটির রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, পাবনা, মৌলভীবাজারসহ সারা দেশে বেশকিছু শাখা রয়েছে। মানসম্পন্ন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পুনর্বাসন সেবার জন্য সিআরপি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। রোগীদের সবচেয়ে আস্থার জায়গাও এটি।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে যেমন স্কয়ার হসপিটাল, এভার কেয়ার হসপিটাল, ইউনাইটেড হসপিটালসহ বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক চেম্বারেও সেবা দিচ্ছেন ফিজিওথেরাপিস্টরা।

সরকারিভাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বরে রয়েছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি, ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপি, ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপি, ক্লিনিক্যাল স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি ব্যবস্থা রয়েছে। এসব চিকিৎসার মাধ্যমে অটিজমের শিকার শিশু বা ব্যক্তি এবং অন্যান্য ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে নিয়মিত থেরাপি সেবা, হিয়ারিং টেস্ট, ভিজ্যুয়াল টেস্ট, কাউন্সেলিং, প্রশিক্ষণ সেবা দিচ্ছে সরকার।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করেছে সরকার, যা স্থানীয়ভাবে প্রতিবন্ধী হাসপাতাল নামে পরিচিত। এসব কেন্দ্রে প্রায় ২০৬ জন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসককে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ছাড়া সরকারি পর্যায়ে বড় পরিসরে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) এখানে একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি রয়েছে চিকিৎসাসেবাও।

যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওথেরাপি পুনর্বাসন বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক মো. ফিরোজ কবির বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে ফিজিওথেরাপি সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্যসেবার সব পর্যায়ে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের পদ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে সব বিভাগীয় পর্যায়ে সরকারিভাবে ফিজিওথেরাপি কলেজ প্রতিষ্ঠা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিওথেরাপি বিভাগ চালু করা প্রয়োজন।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ফিজিওথেরাপি বিভাগের প্রধান সৈয়দ শামীম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে আইন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি কাউন্সিল চালু করা জরুরি। একজন ফিজিওথেরাপিস্টকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলে আনুপাতিক হারে ফিজিওথেরাপিস্টদের প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ করা প্রয়োজন। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতি অনেকটা অবহেলিত। ধরনের চিকিৎসাসেবার প্রসারে সম্মিলিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে রেফারেল পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ তাদের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন