কূপ খননে গ্যাজপ্রমের অর্ধেক বিনিয়োগে বেশি সফল বাপেক্স

আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই একের পর এক কূপ খননের কাজ পাচ্ছে গ্যাজপ্রম

আবু তাহের

দেশের স্থলভাগে গ্যাসকূপ খননে কাজ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) একই সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমও কাজ করছে। তবে দুই দেশের রাষ্ট্র খাতের দুই কোম্পানির মধ্যে কূপ খনন ব্যয়ে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য নিয়ে বরাবরই বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে নিজেদের সক্ষমতা থাকার পরও গ্যাজপ্রমকে বেশি দরে কাজ দেয়ায় নানা সময়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে জ্বালানি বিভাগকে। প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে চুক্তির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, বাপেক্স একটি কূপ খননে যেখানে গড়ে ৭০-৮০ কোটি টাকা নিয়েছে, সেখানে একই কাজ করে গ্যাজপ্রম পেয়েছে গড়ে ১৫০ কোটি টাকা। অথচ বৈশ্বিক জ্বালানি খাতের অনুসন্ধান-উৎপাদনে বিদেশী কোম্পানিটি উল্লেখযোগ্য কাজ করলেও বাংলাদেশে বলার মতো অগ্রগতি নেই।

গ্যাজপ্রমকে দ্বিগুণ অর্থ পরিশোধের বিষয়ে কখনই সদুত্তর পাওয়া যায়নি জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে। বরং বেশি দরে কাজ দেয়ার পেছনে বরাবরই সামনে আনা হয়েছে গভীর কূপ খননে বহুজাতিক কোম্পানিটির সক্ষমতা দক্ষতার বিষয়টি। বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে গ্যাসকূপ খনন সংস্কারে বাপেক্স বড় আকারে কাজ শুরু করেছে। তবে গভীর কূপ খননে এখনো তাদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। আর যেসব জায়গায় বাপেক্সের কাজ করার সক্ষমতা নেই, সেখানেই কেবল গ্যাজপ্রম কাজ করছে। আবার বাপেক্স গ্যাজপ্রম যৌথভাবেও কাজ করছে। এভাবে কাজ করলে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, গ্যাসকূপ খননে বাপেক্স বড় সফলতা পেলেও বরাবরই আলোচনায় থেকেছে রুশ প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম। অথচ গত ১০ বছরে দুই কোম্পানির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে বাপেক্সকেই এগিয়ে রাখতে হবে। বাপেক্সের মাসিক এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, ২০১২-২২ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশে বাপেক্স ২১টি কূপ খনন সংস্কারকাজ করেছে। প্রতিটি কূপ খননে সংস্থাটির গড় ব্যয় হয়েছে ৭০-৮০ কোটি টাকা। এসব কূপের ১০টিরও অধিক উৎপাদনে রয়েছে। আবিষ্কার করা হয়েছে চারটি নতুন কূপ। বাকি কূপগুলো অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক।

অন্যদিকে রুশ প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ১৭টি কূপ খনন করেছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে খনন করা ১০টি কূপের মধ্যে পাঁচটিই বন্ধ হয়ে যায়। যদিও পরে তা বাপেক্স সংস্কার করে গ্যাস উৎপাদনে নিয়ে আসে। এরপর ২০১৬ সালে আরো পাঁচটি গ্যাসফিল্ড এবং ২০১৭ সালে ভোলার শাহবাজপুর ইস্ট- ভোলা নর্থ- আরো দুটি উন্নয়ন কূপ খনন করে। অর্থাৎ ২০১৩-১৮ সাল পর্যন্ত বহুজাতিক সংস্থাটি মোট ১৭টি কূপ খনন করলেও সেগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়নি বলে জানা গিয়েছে। গ্যাজপ্রম যদিও তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম নিয়ে এক বর্ণনায় দাবি করছে, ২০১৩-১৮ সাল পর্যন্ত তারা মোট ৫০ হাজার মিটার গ্যাসকূপ খনন করেছে। তাতে ওই সময়ে দেশের জাতীয় গ্রিডে মোট গ্যাস সরবরাহ ১০ শতাংশ বাড়ে।

বাপেক্স সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে কূপ খননে আবারো নতুন করে কাজ শুরু করেছে গ্যাজপ্রম। গত ১৯ আগস্ট ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের টবগী- কূপের খননকাজ শুরু করে কোম্পানিটি। সেখানে ইলিশা- ভোলা নর্থ- নামে আরো দুটি কূপ খনন করবে রুশ জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানটি। পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, এসব কূপ খনন করতে তারা গড়ে ২৩১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা পাচ্ছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

এদিকে স্থানীয় গ্যাস কোম্পানি বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়ার অভিযোগ বেশ পুরনো। নিজস্ব সংস্থায় বিনিয়োগ না করে দেশের জ্বালানি খাতে বহুজাতিক কোম্পানিটির বিচরণকে ব্যবসায়িক রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল হিসেবে দেখছেন অনেকে। বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাস খাতে রুশ কোম্পানির বিচরণ একটি অদৃশ্য শক্তির কারণে। কোম্পানিটি গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাম লেখালেও আদতে তারা দেশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বহুজাতিক কোম্পানিটির আগমন বিশ্লেষণ করে তার প্রমাণও পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইন, ২০১০-এর আওতায় গ্যাজপ্রম কোনো রকম দরপত্র ছাড়াই দেশের গ্যাস খাতে কাজ করার সুযোগ পায়। বাপেক্স-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গ্যাজপ্রম প্রথমে বাপেক্সের পাঁচটি অনুসন্ধান কূপ খননে সাড়ে কোটি ডলার দর নির্ধারণ করে। প্রতিটি কূপের জন্য গড়ে সে সময় খনন ব্যয় ধরা হয় কোটি ৯০ লাখ ডলার। পেট্রোবাংলার অন্য দুটি কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লিমিটেড (বিজিএফসিএল) সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) পাঁচটি কূপের উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয় ১০ কোটি ২৪ লাখ ডলার। প্রতিটি কূপ খননের গড় দর কোটি ডলারের কিছু বেশি। দর নিয়ে সে সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আপত্তি জানালেও খুব বেশি লাভ হয়নি।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দরপত্র ছাড়াই কাজ পাওয়ায় বাংলাদেশে কাজ করার ক্ষেত্রে গ্যাজপ্রমের নিজস্ব কোনো বিনিয়োগ ছিল না, এখনো নেই। তাছাড়া কূপ খননের আগে পরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে এমন কোনো চুক্তিও ছিল না শুরুতে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে গ্যাজপ্রমের সাফল্য বলার মতো কিছু না। তারা নানা ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দেশের গ্যাস খনির কাজ বাগিয়ে নেয়। তাদের ক্ষেত্রে বরাবরই দুটি বিষয় সামনে আসে, প্রথমটি তারা বাংলাদেশে গ্যাস খাতে কাজ করলেও অনুসন্ধান কূপে কাজ করতে কখনই আগ্রহী নয়। দ্বিতীয়ত, তারা কূপ খননে বাপেক্সের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ নেয়। তাদের মাধ্যমে কূপ খনন করে পেট্রোবাংলার বড় অংকের অর্থ অপচয় হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন