বিবিএ গ্র্যাজুয়েটরা করপোরেটে সফলভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে

প্রাচীনকাল থেকে বাণিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং পেশাও বটে। একজনের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে কম দামে কিনে অনেকজনের কাছে অল্প পরিমাণে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করা হচ্ছে বাণিজ্য। কাজটি সহজ। তবে বাণিজ্য করে লাভ করতে হলে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। একসময় বাণিজ্য পেশায় নিযুক্ত হওয়ার জন্য কোনো শিক্ষার প্রচলন ছিল নাপ্রয়োজনও ছিল না। কালক্রমে দেখা গেল, বাণিজ্যের কাজটি অনেক প্রসার লাভ করেছে এবং কিছুটা জটিল হয়েছে। তাই বাণিজ্য একসময়ে শিক্ষার বিষয় হয়ে উঠল।

বাংলাদেশে বাণিজ্য শিক্ষার ইতিহাস তেমন পুরনো নয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় বাণিজ্য বিভাগ ছিল এবং বি.কম নামে বাণিজ্য শিক্ষার ডিগ্রি শুরু হয়। এরপর কলেজেও বি.কম চালু হয়।

১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখানে দুই বছর মেয়াদি এমবিএ ডিগ্রি দেয়া শুরু হয়।

বাণিজ্য শিক্ষায় প্রধানত হিসাবরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সেবার কার্যক্রম, নীতি পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হতো। এমবিএতে মূলত ব্যবসা ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কলাকৌশল শিক্ষা দেয়া হয়। এখানে ব্যবসার ধারণাটি অনেক ব্যাপক। এটা ক্রেতার চাহিদা নিরূপণ থেকে শুরু করে উৎপাদন বিপণন বিপণন-পরবর্তী সেবা ছাড়াও ব্যবসাসংশ্লিষ্ট যেসব কাজ সেবা প্রয়োজন সে সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা দেয়া হয়। তবে প্রধান যে বিষয়টি বাণিজ্য শিক্ষা থেকে ভিন্ন তা হচ্ছে কীভাবে ব্যবসার প্রতিটি কাজ সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় সে বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। এমবিএতে ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এমনকি হাতে-কলমে ব্যবস্থাপনা শেখার জন্য ছাত্রদের ছয় মাসের জন্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে কাজে নিযুক্ত করা হয়।

১৯৭০ সালের শেষ দিকে আইবিএর এক সভায় বিবিএ চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর জন্য আইবিএর শিক্ষক মুহাম্মদ আলিমউল্যা মিয়ানকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে বিবিএ কারিকুলাম তৈরির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কাজটি মুলতবি হয়ে যায়। বিভিন্ন সমস্যা অনাগ্রহের কারণে বিষয়টি আরো পিছিয়ে যায়। আমরা যারা বাণিজ্যে মাস্টার ডিগ্রি করেছিলাম এবং এমবিএ করেছিলাম তারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারতাম এবং সেই কারণে বিবিএ চালু করার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলাম। তাই ১৯৮৭ সালে যখন ডক্টর আলিমউল্যা মিয়ান পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তখন বিবিএ শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হলো। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে বিবিএ কারিকুলাম তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হলো। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো অ্যাডমিশনের জন্য টেস্ট অন্যান্য কাজ শুরু করার।

কাজটি খুব সহজ ছিল না। কেননা বিবিএ চার বছরের আমেরিকান ধাঁচের ডিগ্রি প্রোগ্রাম হবে। বাংলাদেশ তখন দুই বছরের পাস কোর্স, তিন বছরের অনার্স কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স ছিল। কেবল প্রকৌশল কৃষি ছাড়া চার বছরের কোনো ডিগ্রি ছিল না। মেডিকেল ডিগ্রি ছিল পাঁচ বছরের। প্রথম ধাক্কাটা লাগল চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি কোর্স নিয়ে। যদিও আইবিএর নিজস্ব একটি আইন ছিল কিন্তু সেখানে চার বছরের ব্যাচেলর কোর্স করার কোনো উল্লেখ ছিল না। এর আগে এক বছরের মাস্টার্সের পরিবর্তে দুই বছরের এমবিএ ডিগ্রি চালু করার বিষয়ে তখন কোনো মতভেদ হয়নি। ১৯৮৯ সালে বিবিএর কারিকুলাম তৈরি করে বিভিন্ন কমিটিতে পাস করা হয় এবং সে বছরই বিবিএতে ভর্তির জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। কিন্তু একটি ঈর্ষান্বিত মহল শেষ মুহূর্তে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করতে সফল হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের কোনো ব্যাচেলর ডিগ্রি নেই এবং আইবিএর আইনে এর কোনো উল্লেখ নেই অভিযোগে তারা বিবিএ শুরু করতে বাধা সৃষ্টি করে। জটিলতা নিরসন করতে চার বছর লেগে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে আইবিএতে বিবিএ শুরু করা হয়।

অধ্যাপক আলিমউল্যা মিয়ান ১৯৮৮ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার চিন্তাভাবনা করছিলেন এবং আমাকে বিবিএ কারিকুলাম তৈরির অনুরোধ করেন। কারিকুলামটি প্ল্যানিং একাডেমিতে একটা সেমিনারে শিক্ষাবিদ, ব্যবসা-শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তাদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে কারিকুলামটি পরিমার্জনা করা হয়। আইবিএর পরিচালকের পদ থেকে অবসর নিয়ে অধ্যাপক মিয়ান ১৯৯১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) নামে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে বিবিএ শুরু করেন। পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বিবিএ চালু করে। এরপর অন্যান্য প্রাইভেট পাবলিক ইউনিভার্সিটি বিবিএ ডিগ্রি দিতে থাকে। চার বছর মেয়াদি বিবিএ কারিকুলাম এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে বিবিএ ডিগ্রি সম্পাদনের পর মাস্টার্স কোর্স না করেও চাকরি জীবনে শীর্ষপদ পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে। বিবিএ এখন একটি অতি জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় শিক্ষা কার্যক্রম। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই কলেজেও এখন বিবিএ ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে। বিবিএ ডিগ্রিধারী মেধাবী ছাত্ররা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে করপোরেটে সফলভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিবিএ শুরু করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য আইবিএ বিবিএ শুরু করার জন্য আইইউবিএটির ভূমিকা এবং উভয় ক্ষেত্রে অধ্যাপক আলিমউল্যা মিয়ানের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

অধ্যাপক . আব্দুর রব

উপাচার্য, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন