অনুসন্ধানে বাপেক্স পেয়েছে ১ হাজার কোটি, আমদানিতে ৮৫ হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

পেট্রোবাংলার সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, গত চার অর্থবছর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যদিও জাতীয় গ্রিডে সরবরাহকৃত গ্যাসের ৭৫ শতাংশ আসছে দেশীয় উৎস থেকে। সময়ে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগের পরিমাণ যৎসামান্যই। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে একই সময়ে কূপ খনন জরিপে দেয়া অর্থের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার বেশি নয়। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থবির রেখে এলএনজি আমদানিবাবদ বিপুল অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছে পেট্রোবাংলা। অন্যদিকে অনুসন্ধান উত্তোলনে মনোযোগী না হওয়ায় স্থানীয় গ্যাসের মজুদ প্রায় শেষের পথে।

পেট্রোবাংলার আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জসহ পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মোট ৬৬টি কার্গো আমদানি করে পেট্রোবাংলা। এসব এলএনজিবাহী কার্গো আমদানি করতে সংস্থাটিকে গুনতে হয় ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি ৭২টি কার্গো আমদানির বিপরীতে পেট্রোবাংলার খরচ হয় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে পেট্রোবাংলার প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, জাতীয় গ্রিডে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্ববাজারে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এর বিপরীতে দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে কীভাবে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যায়, তার চেষ্টা চলছে।

এলএনজি আমদানির পথে হাঁটতে গিয়ে স্থানীয় গ্যাসের বড় একটি অংশ দশকের পর দশক অনাবিষ্কৃত থেকেছে। সহজ পথে গ্যাস উৎস খুঁজতে গিয়ে এলএনজি আমদানিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে গ্যাস সংকটের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অর্থ সংকটও।

বৈশ্বিক জ্বালানির বাজার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অস্থিতিশীল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে স্পট মার্কেটে আকাশচুম্বী মূল্যের কারণে কেনা যাচ্ছে না এলএনজি। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহের বাজারও সীমিত। দুই-তিন বছরের মধ্যে বৈশ্বিক গ্যাসের বাজার নিম্নমুখী হওয়ার লক্ষণ দেখছে না জ্বালানির বাজার বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। অবস্থায় নিজস্ব তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এবং স্থানীয় উৎপাদনে জোর দিয়েছে আমদানিকারক দেশগুলো। তবে এমন পরিস্থিতি যে হতে পারে, সে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল গ্যাসের বৈশ্বিক বাজার জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে।

পেট্রোবাংলা বাপেক্সের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, দেশের গ্যাসকূপ খননে গত পাঁচ বছরে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ হয়নি। পাঁচ বছরে বাপেক্সের মাধ্যমে কূপ খননে হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়নি। বাপেক্সের তথ্য ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, দেশের গ্যাসকূপ অনুসন্ধানে ২০১৭ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাপেক্স। রূপকল্প- প্রকল্পের আওতায় দুটি অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। শ্রীকাইল নর্থ- মোবারকপুর সাউথ ইস্ট- দুটি কূপ খননে সংস্থাটি ১৬৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছর রূপকল্প- টুডি সিসমিক প্রকল্প গ্রহণ করে। এটিও মূলত গ্যাস অনুসন্ধানের প্রাথমিক জরিপ। প্রকল্পে সংস্থাটি ১০৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এর বাইরে গত বছরের আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জে একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স। প্রকল্পে বাপেক্সের খরচ হয় ৭৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সাল থেকে নেয়া বাপেক্সে বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোয় মোট ব্যয় ধরা হয় ৩৪৬ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পসহ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের (জিডিএফ) অর্থ ব্যবহার করে বাপেক্স ২০১২ সাল থেকে ২০টি প্রকল্পের কাজ করেছে। এসব প্রকল্পে বাপেক্স হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি বিনিয়োগ করেছে। মূলত নতুন কূপ খনন, সিসমিক সার্ভে, কূপ সংস্কারের মতো প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেকটাই এরই মধ্যে শেষ হয়েছে, আবার অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্প বিশ্লেষণ করে বাপেক্সের সফলতাই বেশি দেখা গিয়েছে। তবে সংস্থাটির কর্মদক্ষতা অনুযায়ী সেই হারে বিনিয়োগ করা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, দেশের কাজ বিদেশী কোম্পানিকে ধরিয়ে দিয়ে একদিকে যেমন বাপেক্সকে বসিয়ে রাখা হয়েছে, অন্যদিকে সাশ্রয়ী কূপ খননের কাজ উচ্চমূল্যে বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে।

দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানি হিসেবে রাশিয়ার গ্যাজপ্রমকে ২০১২ সাল থেকে পর্যন্ত ১৭টি কূপ খননের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এসব কূপ খননের জন্য স্থানীয় কোম্পানির চেয়ে দেড় গুণ কখনো তিন গুণ বেশি দামে কাজ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে সংস্থাটিকে ভোলার তিনটি কূপ খননের দায়িত্ব দেয়া হয়। বর্তমানে ভোলায় কোম্পানিটি তিনটি কূপ খননে ৫৪০ কোটি টাকা অর্থমূল্য নিচ্ছে। সেই হিসাব বিবেচনায় নিলে বাপেক্স আওতাধীন এবং গ্যাজপ্রমের কূপ মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে দেশে ৮৮৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।

যদিও জ্বালানি বিভাগ বলছে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে যথাযথ বিনিয়োগ হয়েছে। সময়ে মোট পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২১টি অনুসন্ধান, ৫০টি উন্নয়ন ৫৬টি ওয়ার্কওভার কূপ খননের ফলে স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। অনুসন্ধান পরিত্যক্ত কূপ খনন করে ২০২৫ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে আরো ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।

সম্প্রতি ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি) আয়োজিত এক সেমিনারে গ্যাস খাতের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, প্রতি বছর নির্দিষ্ট হারে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দেশের গ্যাস অনুসন্ধানে যুক্ত করার জোরালো উদ্যোগ রয়েছে। সরকার চায় দেশে গ্যাস অনুসন্ধান হোক। কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে গ্যাস পাওয়া গেলে সরকার তথা দেশ উপকৃত হবে।

দেশে গ্যাস সংকটের কারণে ২০১৮ সালে এলএনজি আমদানি শুরু করে পেট্রোবাংলা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ওমান থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে জ্বালানি বিভাগ। একই সঙ্গে মূল্যসাশ্রয়কে প্রাধান্য দিয়ে ২০২০ সালে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, দেশে যে হারে গ্যাস সরবরাহ কমেছে, তার বিপরীতে বছরভিত্তিক এলএনজি সরবরাহ বেড়েছে।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ওমান থেকে মোট ৪১টি কার্গো আসে দেশে।

দেশে গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে স্থানীয় বিদেশী কোম্পানি কাজ করেছে। স্থানীয় তিনটি গ্যাস কোম্পানির পাশাপাশি পাঁচটি বিদেশী কোম্পানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করেছে। স্থানীয় কোম্পানির বাইরে বিদেশীদের মধ্যে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাদে বাকিরা উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করতে পারেনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমদানিনির্ভরতার কারণে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে গত এক দশকেরও বেশি সময় উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বরং অনুসন্ধানবিমুখ হয়ে আমদানিনির্ভরতার দিকে নজর দেয়া হয়েছে। ধারাবাহিকতায় গ্যাস উৎপাদন কমার পাশাপাশি ভঙ্গুর দশায় পরিণত হয়েছে গ্যাস খাত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন