জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকট

কমেছে ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানি, বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে

শামীম রাহমান

ব্যক্তিগত গাড়ি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান অটো মিউজিয়াম লিমিটেডের দুটি শোরুম রয়েছে ঢাকায়। একটি গুলশান- নম্বরে, অন্যটি বারিধারায়। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করে সেগুলো বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। দুই শো রুম মিলিয়ে মাসে গড়ে ৫০টির মতো গাড়ি বিক্রি হতো। তবে গত তিন মাস প্রতিষ্ঠানটির গাড়ি বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। বিক্রির পরিমাণ নেমে এসেছে মাসে গড়ে ২০-২৫ ইউনিটে।

অটো মিউজিয়াম লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী হাবিব উল্লাহ ডন। একই সঙ্গে তিনি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। গত তিন মাসে ব্যক্তিগত গাড়ির বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে গাড়ির দাম বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানির এলসি করার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন আরোপ করায় ব্যক্তিগত গাড়ির বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত গাড়ি বিক্রি হয়, তার ৯৫ শতাংশই রিকন্ডিশন্ড। এসব গাড়ির প্রধান ক্রেতা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। সম্প্রতি সরকার ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, পেট্রল লিটারে ৪৪ অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের কিছুটা হলেও গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহিত করছে।

বারভিডার তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হয়েছে প্রায় ২২ হাজার ইউনিট। চলতি বছরের প্রথম দ্বিতীয় প্রান্তিকেও প্রায় একই হারে গাড়ি আমদানি হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় প্রান্তিক থেকে আমদানিতে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। গত তিন মাসে দেশে গাড়ি আমদানি ৫০ শতাংশের মতো কম হয়েছে বলে দাবি করছেন বারভিডার নেতারা। একইভাবে গাড়ি বিক্রিও অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে দাবি তাদের। তারা বলছেন, আগে যে শোরুমে মাসে ১০০টি গাড়ি বিক্রি হতো, সেখানে এখন ৪০-৫০টি গাড়িও বিক্রি হচ্ছে না।

গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন নীতির কারণে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আগে লাখ ডলারের গাড়ি আমদানি করতে গেলে হাজার ডলারের এলসি খুলেই আমদানি করা যেত। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকটের জেরে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসির ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ একটি গাড়ির আমদানি মূল্যের পুরোটাই এলসিতে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর ফলে একটি গাড়ি আমদানি পর্যায়েই অনেক টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে এবং বিনিয়োগের অর্থ গাড়ি বিক্রি না করা পর্যন্ত আটকে থাকছে। অগ্রিম বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের বাড়তি দাম। আগে যে ডলার ৯০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত, সেটা এখন ১০০ টাকার ওপরে কিনতে হচ্ছে। স্বভাবতই এসব বিষয় বড় প্রভাবক হয়ে উঠছে গাড়ির দামের ক্ষেত্রে। আগে যে গাড়ি ৫০-৫২ লাখ টাকায় হতো, তার দাম এখন ৬০-৬২ লাখ টাকায় উঠেছে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শুধু যে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারেই বিরূপ প্রভাব পড়েছে তা নয়, নতুন গাড়ির বাজারেও তৈরি করেছে মন্দা পরিস্থিতি। বাংলাদেশে হুন্দাই ব্র্যান্ডের নতুন গাড়ি বাজারজাত করছে ফেয়ার গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন জানিয়েছেন, গত তিন মাসে তাদের গাড়ি বিক্রি ২৫-৩০ শতাংশের মতো কমেছে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে নতুন রিকন্ডিশন্ড মিলিয়ে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩০ হাজার ইউনিট গাড়ি বিক্রি হয়। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গাড়ির বাজার ভালোই ছিল। এরপর থেকেই বাজারে মন্দা শুরু হয়েছে। আমাদের শঙ্কা, বছর সব মিলিয়ে ২৫ হাজার গাড়ি বিক্রি করাও কঠিন হয়ে যাবে। আগের মতো গাড়ি কিনছেন না ক্রেতারা। সামগ্রিকভাবে নতুন গাড়ির বিক্রি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

তিনি আরো বলেন, গত তিন মাসে আমরা যেসব গাড়ি বিক্রি করেছি, তার একটা বড় অংশ আগেই বুকিং করা ছিল। এখন কিন্তু আমরা আর সেভাবে বুকিং পাচ্ছি না। আগের চেয়ে বুকিং প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। সামনের দিনগুলোয় নতুন গাড়ির বাজারে আরো বড় ধস নামতে পারে।

ব্যক্তি খাত বাদে সরকারও ব্যক্তিগত গাড়ির অন্যতম বড় ক্রেতা। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক গাড়ি কেনে সরকার। তবে চলতি বছরের জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত সংবিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কেনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

সরকারি গাড়িগুলো কেনা হয় মূলত বাংলাদেশ ইস্পাত প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) অধীন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে। সরকারি গাড়ি কেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রগতিরও গাড়ি বিক্রিতে ধস নেমেছে। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছর প্রায় ৭০০ ইউনিট গাড়ি বিক্রি করেছে। কিন্তু এবার ১০০ ইউনিট গাড়ি বিক্রি করা নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রগতির কর্মকর্তারা। বিষয়ে জানতে চাইলে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক বিপণন বিভাগের প্রধান হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার যেহেতু গাড়ি কিনছে না, সেহেতু আমরাও গাড়ি আমদানি কমিয়ে দিয়েছি। ন্যূনতম উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখার জন্য যা আমদানির প্রয়োজন, ঠিক সে পরিমাণই আমরা আমদানি করছি। চলতি অর্থবছর সরকারি পর্যায়ে গাড়ি কেনা বন্ধ থাকলেও আগের অর্থবছরে বাজেট ছিল, কিন্তু গাড়ি কেনা হয়নিএমন কিছু ক্রেতা আমরা পাচ্ছি। সরকার ছাড়াও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে গাড়ি কেনে। আশা করছি, চলতি বছর ১০০ ইউনিটের মতো গাড়ি আমরা বিক্রি করতে সক্ষম হব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন