চীন ও ভারতকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামলাচ্ছেন তানদি দরজি

বণিক বার্তা ডেস্ক

ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানদি দরজি ছবি: দ্য হিন্দু

বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট এখন সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট দক্ষিণ এশিয়ায়। আয়তন অর্থনীতির আকারে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশ ভুটানও সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে জোর দেয়া হচ্ছে দেশটির পর্যটন জলবিদ্যুৎ রফতানি খাতের ওপর। দুই খাতে প্রতিবেশী ভারতের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ভুটান। আবার চীনের সঙ্গে সীমানা নিয়ে বিরোধ থাকলেও তা শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধানের প্রয়াস চালাচ্ছে দেশটি। বেইজিং থিম্পুর মধ্যে সম্পর্কও এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো।

পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন দুই প্রতিবেশী দেশের কোনোটিকেই নাখোশ না করে উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করে চলেছে ভুটান। এক্ষেত্রে বড় কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানদি দরজিকে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বেশ দক্ষতা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভুটানের কূটনীতি সামাল দিয়েছেন তানদি দরজি। দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূরাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেও চীন ভারত উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্কের ভারসাম্য বেশ রক্ষা করে চলেছেন তিনি। ভারসাম্যই এখন দেশটির অর্থনৈতিক সংকট এড়ানোর পথে বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

তানদি দরজি ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ২০১৮ সালে। এর আগের বছরেই বেইজিংয়ের সঙ্গে থিম্পুর সীমান্ত বিরোধ চীন-ভারতকে আরেকটু হলেই মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার বড় আশঙ্কা তৈরি করেছিল। দোকলাম মালভূমি এলাকায় তৈরি হওয়া সংকট ওই সময় থামানো গেলেও চীনের সঙ্গে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ খারাপ অবস্থায় চলে যায়। সেখান থেকে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই বেইজিংয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তানদি দরজি। উদ্যোগ নিয়েছেন সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নিরসনেরও। আবার তা করতে গিয়ে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটতে দেননি তিনি।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট জটিল আকার ধারণ করায় ভুটানে বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অভিঘাত সামলানোর জন্য নিজের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে দেশটি। আবার একই সঙ্গে জলবিদ্যুৎ রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক আয় বাড়ানোর পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। এক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করছেন তানদি দরজি।

ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে পর্যটন খাতের ওপর। এর ধারাবাহিকতায় পর্যটন, নির্মাণ উৎপাদন খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ভুটান এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে বেশি। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, আমাদের এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বাড়তে থাকা সরকারি ঋণ মূল্যস্ফীতি এখন ভুটান সরকারের জন্য বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য ভুটানের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা ভারত। বিষয়ে তানদি দরজির বক্তব্য, ভুটানের রাজস্ব আয়ের প্রধানতম উৎস জলবিদ্যুৎ। এক্ষেত্রে ভারত সরকারের সহযোগিতায় অভ্যন্তরীণ আয়ের ঘাটতি বেশ ভালোভাবেই পূরণ করা গিয়েছে।

১৯৬১ সালের জলঢাকা চুক্তির আওতায় ভারত ভুটানের মধ্যে জলবিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা শুরু হয়। বর্তমানে ভুটানের জিডিপিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা খাত হলো জলবিদ্যুৎ। এছাড়া দেশটির মোট রফতানি আয়েরও ৬৩ শতাংশ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার জন্য খাতটির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ভুটান। বর্তমান পরিস্থিতিতেও ভারতে জলবিদ্যুৎ রফতানি বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে দেশটি। এজন্য দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে কূটনৈতিক তত্পরতা চালানোর বিষয়টিও সমন্বয় করছেন তানদি দরজি। জলবিদ্যুৎ খাতে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতাকে বর্তমান বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

আধুনিক ভুটানের ইতিহাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো তানদি দরজিকেই পার করতে হয়েছে। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর এখন পর্যন্ত চলতি শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ দুই সংকট পার করেছে বিশ্ব। ২০২০ সালের মার্চে বিশ্বব্যাপী কভিডের প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করার পর থেকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার দেখা পায়নি। কভিডের অভিঘাত সামলে ওঠার আগেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বৈশ্বিক জ্বালানি পণ্যবাজারের চলমান ঊর্ধ্বমুখিতায় বিশ্বের অনেক দেশেই রিজার্ভ সংকট মারাত্মক হয়ে উঠেছে। যে কয়টি দেশে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম হলো ভুটান। বিষয়ে তানদি দরজির মন্তব্য, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে ঠিকই, কিন্তু এখনো আমরা বেশ স্বস্তিজনক অবস্থানে আছি। এর প্রধান কারণ ভুটানে যেকোনোভাবে হোক অন্তত এক বছরের রিজার্ভ সংরক্ষণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

অন্য অধিকাংশ মুদ্রার মতো ভুটানের স্থানীয় মুদ্রা নগালট্রামেরও ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার কমে চলেছে। এতে দেশটির আমদানি ঋণ পরিশোধের ব্যয়ও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ডলারনির্ভরতা কমাতে দেশটি স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। একই সঙ্গে জোর দেয়া হচ্ছে দেশটির পর্যটন খাত পুনরুদ্ধারের ওপরও। আগামী সেপ্টেম্বরেই ভুটানের পর্যটন খাত পুরোপুরি চালু করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তানদি দরজি।

ধরনের সব পদক্ষেপেই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন বলে জোর দিয়েছেন তিনি। আবার একই সঙ্গে নয়াদিল্লি-বেইজিং তিক্ততা সত্ত্বেও চীনের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাচ্ছেন ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত বছরের অক্টোবরে দোকলাম সীমান্তে দীর্ঘদিনের বিরোধ নিরসনের জন্য তিন পর্যায়ের একটি রোডম্যাপে সই করে চীন ভুটান।

চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের তিক্ততা কাটিয়ে সীমান্ত বিরোধ নিরসনের পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন তানদি দরজি। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ভুটানকে চীনের সহায়তার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, চীন ভুটান দুই দেশই এখন একে অন্যের সঙ্গে উষ্ণ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক উপভোগ করছে।

তবে চীন ভুটানের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক এখনো গড়ে তোলা হয়নি। এখনই দুই দেশের সম্পর্কের আনুষ্ঠানিকতা রূপ দেয়ার মাধ্যমে ভারতকে চটানোর বিষয়টিতেও এগিয়ে চলছে ভুটান। ১৯৮৪ সালের পর থেকে পর্যন্ত বিরোধপূর্ণ ৪৭৭ কিলোমিটার সীমানা নিয়ে ভুটান চীনের মধ্যে সীমান্ত বৈঠক হয়েছে ২৪ দফায়। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে ১০ দফায়। এর মধ্যে তানদি দরজির অধীনেই আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

বর্তমানে দোকলাম নিয়ে বেইজিং থিম্পুর মধ্যে চলমান আলোচনা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। যদিও তানদি দরজি আশ্বস্ত করেছেন, ওই এলাকায় ভারতের স্বার্থকে উপেক্ষা বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে না ভুটান।

বর্তমান চীন ভুটান দুই দেশই বিরোধ নিরসনের বিষয়ে আশাবাদী। আবার দোকলামে নয়াদিল্লির স্বার্থরক্ষার বিষয়েও ভারতকে আশ্বস্ত করে চলেছেন তানদি দরজি। চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায়ও তার ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির ওপর ভরসা রাখছে ভুটান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন