মোংলা বন্দরের সচলতা বাড়াচ্ছে পদ্মা সেতু

২০২৫ সাল নাগাদ ৩০০০ জাহাজ বন্দরে ভিড়বে

জেসমিন মলি ও শামীম রাহমান

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মোংলা বন্দর হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে বাংলাদেশী গার্মেন্ট পণ্য ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হওয়ার পর বেড়েছে মোংলা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য। খুলনা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে মোংলা বন্দরে তিন হাজার জাহাজ, চার কোটি টন কার্গো আট লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে। এরই মধ্যে আগের চেয়ে বন্দরের সচলতা বেড়েছে। ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিংসহ সার্বিক কাজের জন্য বাড়াতে হবে বন্দরের সক্ষমতা। সেজন্য বন্দরের অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের পরিকল্পনা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় চলমান খুলনা-মোংলা রেলপথ, খানজাহান আলী বিমানবন্দর, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মোংলা ইপিজেড সম্প্রসারণের মতো প্রকল্পগুলো আরো বাড়িয়ে দেয়ার প্রাক্কলন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা প্রধান মো. জহিরুল হক স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত মোংলা বন্দরে জাহাজ ১৭ দশমিক শতাংশ হারে, কার্গো ১৮ দশমিক ৮১ শতাংশ হারে, কনটেইনার দশমিক ৬৭ শতাংশ হারে, গাড়ি ১৪ দশমিক শূন্য শতাংশ হারে এবং রাজস্ব আয় ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ায় ঢাকা ঢাকার আশপাশে আমদানি-রফতানি পণ্য বিশেষ করে গার্মেন্টস সামগ্রী মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পরিবাহিত হওয়ার সহজ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ১৭টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান ২৭ টিইইউএস মালামাল ইউরোপের পোল্যান্ডে রফতানি করেছে।

প্রাক্কলিত চাহিদার বিপরীতে বন্দরের উন্নয়ন ব্যবহার বৃদ্ধির হার অব্যাহত রাখার জন্য বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চ্যালেঞ্জগুলো হলো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ১৪৫ কিলোমিটার চ্যানেলের নাব্যতা বৃদ্ধি সংরক্ষণ, নিরাপদ দূষণমুক্ত পরিবেশবান্ধব চ্যানেল নিশ্চিতকরণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের জন্য বন্দরের জেটি, ইয়ার্ড, আবাসিক স্থাপনা, অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন, পুরনো জলযান প্রতিস্থাপন, নতুন জলযান সংগ্রহ, জলযান মেরামত সুবিধা তৈরি এবং পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নিয়োগ।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, বর্ধিত চাহিদা সুষ্ঠু দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৮টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে ছয়টি প্রকল্প চলমান। অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরো দুটি প্রকল্প।

বাস্তবায়ন করা ১৮টি প্রকল্পের অন্যতম হলো মোংলা বন্দর চ্যানেলের আউটার বার ড্রেজিং। এর মাধ্যমে বন্দরে দশমিক মিটার ড্রাফটের জাহাজ হারবারিয়া পর্যন্ত হ্যান্ডলিংয়ের সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরের দেড় বছরে ১৫৭টি দশমিক থেকে দশমিক মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়েছে।

গত ১০ বছরে বাস্তবায়ন করা আরেকটি প্রকল্প হলো মোংলা বন্দরে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস) প্রবর্তন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে বন্দরে আগত জাহাজের যাবতীয় তথ্য আগেই জানা সম্ভব হচ্ছে। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে। বন্দরের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে।

বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মোংলা বন্দর উন্নীতকরণে সময় লাগবে। বন্দরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এটা করতে আরো দুয়েক বছর লাগতে পারে। এখন অনিয়মিতভাবে বন্দর থেকে পণ্য রফতানি হচ্ছে। আমাদের যেহেতু ইনার বারে ড্রেজিং চলছে, আপগ্রেডেশনের কাজ চলছে; কাজগুলো যখন পুরোপুরি হয়ে যাবে তখন মোংলা বন্দর পুরোপুরি বিকল্প বন্দর হিসেবে কাজ করবে।

যেহেতু ঢাকার সঙ্গে মোংলার দূরত্ব কম, বছরের মধ্যে রেললাইনও যুক্ত হয়ে যাচ্ছে; কাজেই এখানে বহুমাত্রিক যোগাযোগ হবে। কাজেই মোংলা বন্দর আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেসব বিবেচনায় নিয়েই বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।

১৯৫০ সালে একটি ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজের নোঙর ফেলার মাধ্যমে গোড়াপত্তন হয় মোংলা বন্দরের। সুন্দরবনের মধ্যে পশুর নদীর জয়মনিগোল নামক স্থানে সেই জাহাজটি নোঙর করে। পরে ১৯৫১ সালে জয়মনিগোল থেকে ১৪ মাইল উজানে চালনায় বন্দর স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৪ সালে সেটি চালনা থেকে সরিয়ে মোংলায় নেয়া হয়। মোংলা নদীর তীরে স্থাপন হওয়ায় বন্দরের নাম হয় মোংলা। ১৯৭৬ সালে চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ নামক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করার পর ১৯৮৭ সালের মার্চে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদনে মোংলা বন্দর গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। নেপাল, ভুটান ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলসহ মিয়ানমার এবং চীনের ল্যান্ড লক এলাকায় পণ্য পরিবহনেও মোংলা বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এরই মধ্যে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হলে মোংলা বন্দরের ব্যবহার বহুগুণ বাড়বে এবং এটি একটি আঞ্চলিক হাব হিসেবে পরিচিত হবে। এছাড়া আগামী সেপ্টেম্বরে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন হলে প্রতি বছর কমপক্ষে ৪৫ লাখ টন কয়লা আমদানি করতে হবে। সেটিও করা হবে মোংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে। বন্দর এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হলে বন্দরের ব্যস্ততা আরো বাড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন