নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন। কিছু পণ্য তো রীতিমতো রেকর্ড গড়েছে, যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলছে। করোনা মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা, তারপর আবার রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। সবকিছু যেন দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর কষ্ট লাঘবে আরো এক কোটি পরিবারকে ‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই কার্ড দেখিয়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছ থেকে নিত্যপণ্য মিলবে ভর্তুকি মূল্যে। এর আগে গত মার্চ-এপ্রিলে এক কোটি পরিবারকে টিসিবির ‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ (২৭ জুলাই ২০২২) তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৫১৬ জন। আর প্রতিটি পরিবারে গড়ে চারজন করে সদস্যের বাস। সে হিসেবে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কেনার সুবিধাভোগী গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আট কোটিতে। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবার টিসিবির পণ্যের আওতায় আসছে, যারা নিম্ন আয়ের।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বড় সমস্যা। এ কারণে জনগণের যে বেশ কষ্ট হচ্ছে, তা সরকার অবশ্যই অনুভব করে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। স্বল্প আয়ের মানুষকে এর থেকে রেহাই দিতে সরকার এরই মধ্যে টিসিবির মাধ্যমে প্রতি মাসে এক কোটি পরিবারের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করছে। চিন্তাভাবনা চলছে আরো মানুষকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সুবিধাভোগী পরিবারের সংখ্যা দুই কোটিতে নিয়ে যাওয়া যায়। অর্থ মন্ত্রণালয় এটি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করছে। যথাসময়ে সরকার ঘোষণা (নতুন এক কোটি ‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেয়া) করবে।
‘ফ্যামিলি কার্ডের’ মাধ্যমে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে নিজেদের করা গবেষণা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জানায় সংস্থাটি। এছাড়া টিসিবির কার্যক্রমে অভিযোগ নিরসন বা পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করে টিআইবি। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনাকালে ‘২ হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তা’ কর্মসূচির আওতাভুক্ত সাড়ে ৩৮ লাখ উপকারভোগীর সবাইকে রেখে নতুন করে আরো সাড়ে ৬১ লাখ মানুষকে যুক্ত করে মোট এক কোটি পরিবারকে ‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু নগদ সহায়তা কর্মসূচির আওতাধীন প্রায় সাড়ে আট লাখ উপকারভোগীই ‘ফ্যামিলি কার্ড’ পাননি। দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলগুলোতেও (পার্বত্য এলাকা, দ্বীপ ও চরাঞ্চল এবং দুর্যোগপূর্ণ হাওর) পণ্য সরবরাহে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় টিসিবি। উদাহরণ টেনে বলা হয়, বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকার প্রায় ৩ হাজার ৩০০ পরিবারের কাছে টিসিবির সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য পৌঁছাতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। আবার পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র দূরে হওয়ায় প্রত্যন্ত এলাকা, চরাঞ্চল, হাওর ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকার কার্ডধারীরা পণ্য কিনতে আগ্রহী হন না। অনেককেই আবার পণ্য কিনতে যাতায়াত বাবদ ৩৩ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। ডিলারদের বিরুদ্ধে প্যাকেজ মূল্যের অতিরিক্ত ৪০-৫০ টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়টিও উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, কোটি পরিবারকে এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে বাস্তবে এ প্রশংসনীয় উদ্যোগ প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এখন নতুন করে আরো এক কোটি কার্ড দেয়া সরকারের সময় উপযোগী উদ্যোগ। সে ক্ষেত্রে যেন যারা প্রকৃত উপকারভোগী তারা কার্ড পায় সেটি নিশ্চিত করা। কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি যেন না হয় সে বিষয় নিশ্চিত করা এবং আগেরবার যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে দলীয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটি পরিহার করতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, অনেকেই ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে। এখন টিসিবির নতুন করে এক কোটি কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা কতটুকু সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।
কার্ড বিতরণ ও পণ্য বিক্রিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, নগদ সহায়তা কর্মসূচি ছিল করোনাকালে। তখন অনেকেই কর্মহীন ছিলেন। এখন যারা কর্মে যুক্ত হয়েছেন তাদের থেকে কেউ কেউ বাদ পড়েছেন। তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সূচকের পরিপ্রেক্ষিতে কোন জেলায় কত দুস্থ লোক আছে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় নিম্ন আয়ের মানুষকে কার্ড দেয়া হয়। এছাড়া আমাদের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। সক্ষমতা না থাকায় মূলত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতা নিচ্ছি। তবে পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়ানোর কারণে যেন কারো কর্মঘণ্টা নষ্ট না হয়, সেজন্য এখন যেকোনো সময় কার্ডধারীরা ডিলার পয়েন্টে গিয়ে পণ্য কিনতে পারবেন। নতুন পণ্য কেনার বিষয়ে টিসিবি চেয়ারম্যান বলেন, খোলাবাজার থেকে কিছু কেনা হচ্ছে, কিছু আমদানি করা হচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে তিন কোটি লিটার তেল আমদানির অনুমতি পেয়েছি।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, একজন মানুষ দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট বা ১৮০ টাকা (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে) কম আয় করলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন বলে ধরে নেয়া হবে। বাংলাদেশও একই মানদণ্ডে দারিদ্র্যসীমা বিবেচনা করা হয় বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। আর সে হিসাব ধরে বিবিএস পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) প্রতিবেদনে সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার উল্লেখ করা হয় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) উল্লেখ করা হয় দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দারিদ্র্যের হার নিয়ে এক জরিপ প্রকাশ করে। তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ বলে দাবি করে সংস্থাটি।
জানতে চাইলে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, টিসিবির কার্ড বিবেচনায় দারিদ্র্যের হার নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ সরকার এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়নি। তবে এতে একটা ধারণা পাওয়া যায় যে দেশের কী পরিমাণ মানুষ অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে আছে। হয়তো মনে করা হচ্ছে, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ ২০ শতাংশ যদি দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকে তাহলে আরো ২০-২৫ শতাংশ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে থাকে। তখন মূল্যস্ফীতি বা এ ধরনের সমস্যায় তারাও দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসতে পারে।
‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেয়ার উদ্যোগ প্রশংসনীয় উল্লেখ করে সেলিম রায়হান বলেন, কার্ডের আওতায় পণ্য বাড়ানো প্রয়োজন। এখন টিসিবি যদি দুই কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় নিয়ে আসে, তাহলে বাজারের ওপরও চাপ কমবে। পণ্যের মূল্য কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। তবে এর জন্য সরকারকে খোলাবাজার থেকে পণ্য না কিনে বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে যেন স্বচ্ছতা বজায় থাকে সে জন্যও একটা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ থাকা উচিত। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও প্রশাসনকেও যুক্ত করা যেতে পারে।