আসলে যেমন ছিল লাল সিং চাড্ডা

আসরার আবেদিন

টম হ্যাংকস অভিনীত ফরেস্ট গাম্প মুক্তি পেয়েছিল ২৮ বছর আগে। গল্পে ছিল সরলতার মাঝে সূক্ষ্ম বিদ্রূপ। এর মাঝে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলো এসেছিল কৌশলে, ক্ষেত্র বিশেষে গল্প অনুসারে। সে সিনেমাটি অবলম্বনেই নির্মিত হয়েছে লাল সিং চাড্ডা অভিনেতা অতুল কুলকার্নির চিত্রনাট্যে সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন অদ্বৈত চন্দন। প্রযোজনায় আমির খান এবং সিনেমাটি ফরেস্ট গাম্পের মূল প্রযোজক পরিবেশক প্যারামাউন্টের অনুমতি সাপেক্ষে তৈরি। অর্থাৎ অফিশিয়াল রিমেক।

ফরেস্ট গাম্পের সঙ্গে লাল সিংয়ের তুলনা চলেই আসে। সেটা গল্প হোক বা অভিনয়। ফরেস্ট গাম্পের একটি প্রচলিত অভিধা আছেট্রু ব্লু আমেরিকান সিনেমা। সেটাকে ভারতের পটভূমিতে আনা বেশ কঠিন। কিন্তু অতুল কুলকার্নি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। ফরেস্টের মতো লালও ভারতের ইতিহাসের ভাঙা-গড়ার নানা কালপর্বের মধ্য দিয়ে যান। কিন্তু সেখানে আমেরিকার ষাট, সত্তর, আশির ঘটনাগুলো যে সাবলীলতা পেয়েছিল লাল সিংয়ে তেমনটা হয়নি। এটা দর্শকদেরই অভিমত। ব্যাপারটি হলো লাল সিংয়ে যে ইমোশন দেয়া হলো তা সাত-আট বছর আগে দর্শক পছন্দ করত, কিন্তু এখন তাদের রুচি বদলে গিয়েছে।

আমির খানের অভিনয় নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। লাল সিংয়ের পাগড়ি, দাড়িসহ চেহারায় ঢাকা পড়লেও তরুণ লাল সিং চরিত্রে আমির খানের মধ্যে পিকে চরিত্রটি বারবার এসেছে। একটি দৃশ্যে নাগা চৈতন্যের সঙ্গে আমির খানকে দেখা যায়, যেখানে বালা (চৈতন্য) কথা বলতে থাকে আর আমির চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখেন। সেখানে যেকোনো দর্শকের মনে হবে তারা পিকের আমির খানের অভিনয় দেখছেন। আমির খানের অভিনয়ে ধরনের পুনরাবৃত্তি দর্শককে হতাশ করেছে। ফরেস্ট গাম্প শারীরিক মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জড একজন মানুষ, লাল সিংও তাই। টম হ্যাংকস তার সীমাবদ্ধতা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে বুঝিয়েছেন। অভিব্যক্তিতে তিনি পরিমিতিবোধ দেখিয়েছেন। লাল সিংয়ে আমির খান তার কথা বলার মধ্যে বিষয়টির প্রমাণ রাখতে চেয়েছেন, কিন্তু সেটা ভাঁড়ামোয় পরিণত হয়েছে। ফরেস্ট যেখানে একটু টেনে টেনে কথা বলে, লাল তার কথার মধ্যে বারবার হুম বলে এবং ভারতীয় বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় দেখা গিয়েছে তারা বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ট্রল করছেন।

তাহলে লাল সিংয়ে ভালো কি কিছুই নেই? একদম যে নেই তা বলা যাবে না। সিনেমাটিতে বলিউডের সেই পুরনো ভাবধারাটি আছে, যা বলিউডের দর্শক নব্বইয়ের শেষ বা ২০০০ সালের শুরুর দিকে পেয়েছেন। রিমেক হলেও লাল সিং চাড্ডা বেশ ফ্রেশ একটা সিনেমা। কারিনা কাপুরের সঙ্গে আমির খানের রসায়ন খারাপ হয়নি। কিন্তু ফরেস্ট গাম্প দেখা দর্শকরা জেনিকে মিস করবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে সিনেমাটোগ্রাফি দৃশ্যায়নে খামতি নেই। যুদ্ধের দৃশ্যগুলো, বুব্বার সঙ্গে ফরেস্টের বন্ধুত্বের বিষয়গুলো বালার সঙ্গে লালের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমিরের অতি অভিনয়ের কারণে সাবলীল বিষয়টিও ফিকে হয়ে গিয়েছে। ধরনের অতি অভিনয় আমির খানের কাছ থেকে দর্শক আশা করে না নিশ্চয়ই।

ফরেস্ট গাম্পের রিমেক বলেই প্রশ্ন আসে, একটা ব্লু আমেরিকান স্টোরিকে কি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে আনা যায়? এর মধ্যে জানা গিয়েছে কুলকার্নির চিত্রনাট্যটি ১২ কি ১৪ বছর আগে লেখা এবং তখন আমির দুই বছর পর্যন্ত চিত্রনাট্যটি ভরসা করে পড়েননি। কিন্তু ১৯৮৩ সালে ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়, অমৃতসরে অপারেশন ব্লু স্টার, শিখ দাঙ্গা, সুস্মিতা সেনের মিস ইউনিভার্স হওয়া বা ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডসব মিলিয়ে অতুল ঠিকই একটা ব্লু আমেরিকান গল্পকে ভারতের প্রেক্ষাপটে এনেছিলেন। কিন্তু গল্পটি উপস্থাপনে অদ্বৈত চন্দনের কিছু খামতি ছিল। চিত্রনাট্যেও অবশ্য দ্বিতীয় অংশ একটু বেশিই ধীর। গোলগাপ্পা দিয়ে চকোলেট বক্স প্রতিস্থাপন পছন্দ করেনি অনেকে। বাস স্টপ হয়েছে পাঞ্জাবের লোকাল ট্রেন। আর অবধারিতভাবে ফিরে এসেছে কার্গিল যুদ্ধ। কিন্তু সবকিছু একটা জায়গায় গিয়ে মেলার কথা, কিন্তু সেটা হয়নি।

তবে দর্শক পছন্দ করেছে শিশু লালকে। ফরেস্ট কিংবা লাল সিংয়ের সরলতার যে থিমটি তা আমিরের মধ্যে না এলেও লালের শিশুকালের চরিত্রে অভিনয় করা আহমেদ ইবনে ওমরের মধ্যে ছিল। মানসিক শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড একটি শিশুর জীবন কেমন হয় তা ওমর দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। মোনা সিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের চিত্রায়ণ ছিল সিনেমার অন্যতম একটি ভালো দিক। যদিও তার অনেকটাই মাই নেম ইজ খানের কথা মনে করিয়ে দেয়। সূত্রে বলে রাখা ভালো, দর্শক পছন্দ করেছে শাহরুখ খানের ক্যামিও। কিন্তু এতকিছু থাকার পরও সিনেমাটি সব মিলিয়ে একজন দর্শকের কাছে পূর্ণতা নিয়ে ধরা দেয় না। একটা রেশ তৈরি হতে হতেও হয় না। লাল সিংয়ের এখানেই ব্যর্থতা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন