চলতি বিশ্ব

পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ফাটকাবাজিও রোধ করতে হবে

জয়তী ঘোষ

গত বছর থেকেই প্রাথমিক পণ্যের দাম বাড়ছে। বিশেষ করে আমরা যদি বিগত ছয়  মাসের কথা বলি। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ফিউচার মার্কেটে ক্রুড অয়েলের দাম বেড়েছে ৩৯ শতাংশ, অর্থাৎ ব্যারেলপ্রতি ৮৯ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ১২৪ ডলারে। পরের মাসে ২৩ শতাংশ দাম কমে ব্যারেলপ্রতি হয়েছে ৯৫ ডলার। এরপর আবার জুনের দিকে দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি হয় ১২২ ডলার, তবে আগস্টে কমে দাঁড়ায় ৮৮ ডলারযা ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকের দামের তুলনায় কম।

গমের বৈশ্বিক মূল্যেও একই ধরনের অস্থিরতা চোখে পড়ে। জানুয়ারিতে শীতকালীন লালচে গমের মূল্য প্রতি টনে ছিল ৩৩২ ডলার, এপ্রিলে তা বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছে ৬৭২ ডলারে। কিন্তু জুনের দিকে দাম কমে ৩৮০ ডলার হলেও গত বছরের দামের তুলনায় এখনো ৫০ শতাংশ বেশি দামে পণ্যটি কিনতে হচ্ছে। যদিও এটি বসন্তকালীন মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় কম। নাটকীয় মূল্যবৃদ্ধি কিন্তু বাস্তবের চাহিদা কিংবা জোগানের পরিবর্তনের কারণে হয়নি। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ ঘোষণার জন্য সরবরাহ সংকটের কারণে পণ্যের মূল্য চড়া হওয়ার বিষয়টিও কিন্তু পুরোপুরি সঠিক নয়। তাছাড়া বড় বড় তেল কোম্পানি এবং কৃষিপণ্যনির্ভর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধি নির্দেশ করে, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যথাক্রমে জ্বালানি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে। যদিও তারা তাদের দাম বাড়ানোর ন্যায্যতা প্রমাণে যেকোনো স্তরে নামতে পারে। বিশেষ করে হেজ ফান্ডের মতো আর্থিক সংস্থাগুলো, যারা ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করে, তারা তাদের উন্মত্ত ফাটকা ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছে, যেটি আমি আগেও উল্লেখ করেছি।

সম্প্রতি কবির আগারওয়াল, থিন লেই উইন এবং মার্গট গিবস তাদের একটি গবেষণায় প্যারিসের গমের বাজারে ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডগুলোর অতিসক্রিয়তার বিষয়টি খুঁজে পেয়েছেন। যে কারণে ২০১৮ সালের মে মাসে ২৩ শতাংশ থেকে ২০২২ সালের এপ্রিলে গমের মূল্য ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এমনকি চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৫০ শতাংশ দাম বাড়ার নেপথ্যে জাতীয় বিনিয়োগ তহবিলের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাকৃতিক গ্যাসের ভার্চুয়াল ট্রেডিং পয়েন্ট টাইটেল ট্রান্সফার ফ্যাসিলিটির (টিটিএফ) লেনদেনের পরিমাণ গত এক দশকে ক্রমাগত বেড়েছে, যেমন ২০১১ সালে প্রায় ১৪ বারের মতো মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও ২০২০ সালে এসে হয়েছে ১১৪ বারের বেশি।

ধরনের ফাটকাবাজি যে বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, চলতি বছরের মার্চেই তা আর একবার তার প্রমাণ পাই। যখন নিকেলের দামের একটি নাটকীয় বৃদ্ধি লন্ডন মেটাল এক্সচেঞ্জকে (এলএমই) লেনদেন স্থগিত করতে এবং সব চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রে অবশ্য নিয়ন্ত্রিত লেনদেনের বাইরে যে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) লেনদেনগুলো ঘটে তা আংশিকভাবে দায়ী ছিল। যদিও এলএমই এখন দাবি করছে, সব ব্যবসায়ীকে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে সরাসরি লেনদেন তথ্যসহ ওভার দ্য কাউন্টারের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে হবে।

তবে, বিভিন্ন পণ্যের বাজার বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে কারণ হেজ ফান্ড এবং বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা এখানে যতটা দ্রুততার সঙ্গে আসে ঠিক ততটা দ্রুতই তারা বাজার থেকে বেরিয়ে যায়। খাদ্য, জ্বালানি যেমন জীবনধারণের জন্য তেমন মৌলিক ধাতু জাতীয় পণ্যগুলো উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভোগ্যপণ্যের দামের অস্থিরতা জীবনযাত্রার মান পণ্য এবং পরিষেবা উৎপাদনের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করে। বর্তমানে আমরা যেমনটা দেখছি, বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলো ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁপছে। অবস্থায় মূল্যের স্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য, যা শুধু মূল্যস্ফীতি রোধ করার জন্যই নয়, অন্য অনেক কারণও রয়েছে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিষয়গুলোকে ঘটতে দেয়া হয় কিংবা আগে থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হয় না। এটা মনে করার অবকাশ নেই, নীতিনির্ধারকরা বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেগুলো ঘিরে চলমান উন্মত্ত আর্থিক কার্যকলাপের প্রভাব সম্পর্কে অসচেতন। তারা স্পষ্টই সচেতন। আমি ২০০৭-০৯ সালের ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের কিছুটা মিলও দেখতে পাই। ওই সময় তেল খাদ্যপণ্যের দাম প্রথম দিকে ব্যাপক বেড়ে যায়, এরপর ১৮ মাসের ব্যবধানে আগের পর্যায়ে নেমে আসেকিন্তু ততক্ষণে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। অভিজ্ঞতা ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর, আমেরিকা যুক্তরাজ্য উভয়ই (ডড-ফ্রাঙ্ক আইনের মাধ্যমে) নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজতে শুরু করে।

আদর্শগতভাবে ফাটকাবাজি রোধে ধরনের প্রবিধানে নিশ্চিত করা উচিত যে যাবতীয় লেনদেন নিয়ন্ত্রিত এক্সচেঞ্জের মাধ্যমেই সংগঠিত হবে, ওভার দ্য কাউন্ডার মার্কেটের ভিত্তিতে নয় এবং বিড সম্পর্কিত সব তথ্যসহ ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে দর কষাকষির পদ্ধতিগুলোও স্বচ্ছ হতে হবে। যারা সরাসরি ব্যবসা পরিচালনায় আগ্রহী এক্সচেঞ্জগুলো শুধু তাদের ব্যবসার অনুমতি দেবে। উদাহরণস্বরূপ একটি এয়ারলাইন কোম্পানিকে বিমানের জ্বালানির জন্য ফিউচার মার্কেটে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেয়া উচিত কিন্তু হেজ কোম্পানিকে ধরনের অনুমতি দেয়া উচিত নয়। এছাড়া বাজারে অংশগ্রহণকারীদেরও সুনির্দিষ্ট সীমা মেনে চলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, যেন তারা নিজ নিজ অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারে। এখানে আমেরিকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রবিধানগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের বাজারগুলো মূলত বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু অঞ্চল দুটি তাদের আগের নিয়ম-কানুন থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতে সক্ষম না হওয়ায় এক ধরনের জলাবদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের নিয়মানুযায়ী বেধে দেয়া এক্সচেঞ্জ রেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করে বাজার থেকে বাড়তি সুবিধা নেয়ার বিষয়টি প্রতিরোধ করতে পারে। তবে তারা এখনো ওটিসি লেনদেনের অনুমতি দিচ্ছে, যা বাজার খেলোয়াড়দের ফাটকাবাজি চালিয়ে যেতেও সক্ষম করছে। আমেরিকা অবশ্য বেশির ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে ওটিসি লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে কিন্তু আর্থিক খেলোয়াড়রা এখনো প্রক্সির মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ করতে পারে। তাছাড়া বাজারমূল্য প্রভাবিত করে, এমন বড় বড় বিডগুলোকেও তারা নীতি দিয়ে আটকাতে পারছে না।

অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মানুষের জীবন-জীবিকাকে আরো বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। সৌভাগ্যবশত নিয়ন্ত্রকদের টনক নড়ার দু-একটা লক্ষণ দেখতে পারছি। সম্প্রতি জি-২০ বৈঠকে ডাচ অর্থনীতিবিদ ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বোর্ডের (জি-২০ দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থমন্ত্রী এবং নিয়ন্ত্রকদের একটি দল) প্রধান ক্লাস নট, ফাটকা কার্যক্রমগুলো ঘিরে নিবিড় পর্যবেক্ষণের অহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, খাদ্য, জ্বালানি, ধাতুর মতো পণ্যগুলোকে ঘিরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নির্ভরতার মানে হচ্ছে এর উৎপাদক ব্যবসায়ীদের যেকোনো ধরনের আর্থিক বিঘ্ন পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের বাহ্যিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।

এখন তাই নিছক নজরদারি যথেষ্ট নয়, পণ্যবাজার ঘিরে ফাটকাবাজি রোধ করতে নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। তাছাড়া এখানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবও লক্ষণীয়। যার মানে সাধারণ মানুষ যন্ত্রণায় পিষ্ট হলেও নিয়ন্ত্রক নীতিনির্ধারকরা এখনো আর্থিক স্বার্থকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছেন।

স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

 

জয়তী ঘোষ: ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েটসের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি এবং ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের সদস্য

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন