উত্তরা ট্র্যাজেডি

দুর্ঘটনা না অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড?

মোহাম্মদ গোলাম নবী

দুর্ঘটনায় হত্যাকাণ্ড যেভাবে বাড়ছে তাতে সর্বশেষ সংযোজন হলো উত্তরায় ক্রেন ভারসাম্য হারিয়ে নির্মাণাধীন অবকাঠামোর গার্ডার প্রাইভেট গাড়ির ওপর পড়ে ঘটনাস্থলেই পাঁচজনের মৃত্যু।

ক্রেন দিয়ে ভারী বস্তু তোলার সময় কিংবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানোর সময় দুর্ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। গুগল সার্চ দিয়ে দেখলাম, বিশ্বের উন্নত সব দেশেই ক্রেন-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তাহলে বাংলাদেশের দুর্ঘটনা নিয়ে কেন প্রশ্ন করছি যে, এটাকে কি দুর্ঘটনা বলা যাবে নাকি এটা খুন।

ধরনের প্রশ্ন করার কারণ হলোউন্নত দেশগুলোয় সব ধরনের নিরাপদ ব্যবস্থা থাকার পরও ক্রেন দুর্ঘটনায় মানুষ পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। অর্থাৎ ক্রেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আদর্শ নিয়ম মেনে যত ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেগুলো নেয়ার পরও ক্রেন-সংক্রান্ত মন্দ ঘটনা ঘটে এবং তাতে মানুষ পর্যন্ত মারা যায়।

অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তফাত্টা এখানেই। উত্তরায় যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে ক্রেন দিয়ে ভারী বস্তু তোলাসহ ক্রেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আদর্শ নিয়ম মানা তো দূরের কথা ন্যূনতম নিয়ম পালন করা হয়নি। ঢাকা উত্তরের মেয়র মহোদয় যেভাবে বলেছেন, কমপ্লায়েন্সের পুরো ঘাটতি ছিল সব জায়গায়। অবহেলা খুনের পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় আর কী কারণ থাকতে পারে।

এখন দেখা যাক, কাজের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ব্যাপারে বাংলাদেশের আইন কী বলে?

বাংলাদেশের পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির ৮০ ধারায় আইনানুগ কার্য সম্পাদনকালে দুর্ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে: দুর্ঘটনা অথবা দুর্ভাগ্যবশত এবং কোনো প্রকার অপরাধমূলক উদ্দেশ্য বা অবগতি ব্যতিরেকে আইনানুগ প্রণালিতে আইনগত মাধ্যমের সাহায্যে এবং যথাযথ যত্ন সতর্কতার সঙ্গে সম্পাদিত কোনো আইনানুগ কাজ অপরাধ নয়।

উত্তরায় যে নির্মাণকাজ চলছে সেটা আইনানুগ কাজ বটে কিন্তু সেই কাজ যথাযথ যত্ন সতর্কতার সঙ্গে সম্পাদিত হচ্ছিল কিনা সেই প্রশ্ন রয়েছে। বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলাপ করার আগে দণ্ডবিধিতে হত্যাকাণ্ড নিয়ে কী বলা হয়েছে একটু দেখে নিই। দণ্ডবিধির ৩০০ ধারায় কোন ধরনের প্রাণহানি হত্যাকাণ্ডের পর্যায়ে পড়বে তা নিয়ে চারটি ভাগে লেখা হয়েছে; সেখানে চতুর্থ ভাগে বলা হয়েছেযে ব্যক্তি কাজটি করে যদি সেই ব্যক্তি জানে যে, কাজটি এমন বিপজ্জনক যে তার ফলে খুব সম্ভব মৃত্যু ঘটবে কিংবা মৃত্যু ঘটতে পারে এবং তিনি যদি সেই কাজটি করেন।

উত্তরার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, সেখানে গার্ডার তোলার জন্য সঠিক মানের ক্রেন ব্যবহার করা হয়নি। ধরনের একটি বিপজ্জনক কাজ করার ক্ষেত্রে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার যে নিয়ম সেটা মানা হয়নি কিংবা নিরাপদ দূরত্ব মেনে গাড়ি চালানোর কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। যে কারণে আমরা দেখতে পাই, ঢাকা উত্তরের মেয়র বলেছেন, কোনো কমপ্লায়েন্সই ছিল না। ফলে তিনি কাজ স্থগিত করছেন। কাজ স্থগিত করার সিদ্ধান্তটি ভালো কিন্তু ঘটনা ঘটার আগেই কেন কমপ্লায়েন্স মানা হয়নি? কিংবা তার তদারকি করা হয়নি? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আর জায়গা থেকেই জনমনে উপলব্ধি আসে যেএগুলো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। মানুষের মনে উপলব্ধি একদিনে তৈরি হয়নি কিংবা উত্তরার ঘটনা থেকে আসেনি।

অনেক কাল ধরেই সড়কে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মানুষ যেভাবে মারা যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে কতগুলো দুর্ঘটনা আর কতগুলো হত্যাকাণ্ড তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এবং আমরা দেখি যে, প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় আসামিপক্ষ দণ্ডবিধির ৮০ ধারার আশ্রয় নিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে এটা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, এগুলো ৩০০ ধারায় খুন কিংবা ৩০৪ ধারায় অবহেলা কিংবা বেপরোয়া যান চালনার কারণে মৃত্যু ঘটেছে। বিশেষ করে ১০ বছর ধরে বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন সিসিটিভি, সেলফোন, ক্যামেরা ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ায় জনসাধারণের কাছে দুর্ঘটনা খুনের পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ব্যাপকসংখ্যায় সম্ভবত প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনা আর হত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার পর। কারণ রানা প্লাজা যেদিন ভেঙে পড়ল তার আগের দিন ওই ভবনে বড় ধরনের ফাটল শনাক্ত করা হয়েছিল। সেই ফাটলকে ভবনের মালিক সামান্য প্লাস্টার খসে পড়া বলে উল্লেখ করেছিলেন। অন্যদিকে সরকারের প্রশাসন যন্ত্র ফাটল পরিদর্শন করলেও সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে পরের দিন সকালে নয়তলা ভবন ধসে পড়ে মৃত্যুর মিছিল তৈরি হয়েছিল। মারাই গিয়েছিল হাজার ১২৯ জন এবং নিখোঁজ থাকা প্রায় এক হাজার মানুষের ভাগ্যে কী ঘটেছে আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। আবার তাজরীন ফ্যাশনের আগুন লাগাটা দুর্ঘটনা হলেও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার কারণ ছিল অবহেলা এবং আগুন লাগার মতো ঘটনা মোকাবেলায় ভবনে যে যে সুবিধা থাকার কথা সেগুলো না থাকা। ফলে মানুষ মনে করে তাজরীন ফ্যাশনের দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যেতে পারত, তারচেয়ে বেশি মরেছে। কারণ তাদেরকে খুন করার মতো পরিস্থিতি সেখানে তৈরি ছিল। আর এখানেই উন্নত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তফাৎ। আর সে কারণেই উন্নত দেশে যেটা দুর্ঘটনা সেটা আমাদের দেশে খুন কিংবা খুনের শামিল।

উন্নত দেশে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করার পর দুর্ঘটনা ঘটে এবং তাতে মানুষ মারা যায়। আর আমাদের এখানে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে রাখা হয় এবং তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। ফলে দুর্ঘটনা থেকে মৃত্যু যত হতে পারে তারচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এবং বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশে ধরনের ঘটনাগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার হয় না কিংবা বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হতে থাকে। তাজরীন ফ্যাশন কারখানার অগ্নিকাণ্ডের অভিযোগপত্র বানাতেই এক বছর পার করা হয়েছিল। আর ঘটনার পর ১০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণই শেষ হয়নি। অন্যদিকে আমরা যদি উন্নত বিশ্বের অন্যতম দেশ আমেরিকায় সংঘটিত ক্রেন দুর্ঘটনার কথাই ধরি, তাহলে দেখা যায় সেখানে মোটামুটি দুই বছরের মধ্যে রায় ঘোষণা রায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবং অপরাধীদের শাস্তি মোটা অংকের জরিমানা করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। গুগল করলে আপনি -সংক্রান্ত অনেক মামলার রায় সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমি শুধু একটা বলিআমেরিকার সিয়াটলে একটি নির্মাণাধীন ভবনের ওপর থেকে ঘূর্ণি বাতাসে ক্রেনের অংশবিশেষ ভেঙে রাস্তায় পড়লে গাড়িতে থাকা পথচারী মিলিয়ে চারজন মারা যায় এবং চারজন আহত হয়। ২০১৯ সালের ঘটনার চূড়ান্ত রায় হয়েছে ২০২২ সালে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বা হাজার ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে দায়ী কোম্পানিগুলো। এর বিপরীতে আমরা দেখি, আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা, পথচারীরাসহ সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বেশির ভাগ সময় কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না কিংবা যা পায় সেটা নেহাতই অপ্রতুল। হয়তো কাফনের কাপড় কিংবা দাফনের জন্য কিছু অর্থ কিংবা বাড়িতে মরদেহ নেয়ার টাকা। মোটা দাগে এই হলো আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণের চিত্র।

আমরা কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ দিই। এমনকি উত্তরার ঘটনায়ও কেউ কেউ বলছেন এমন ঘটনা তো বিদেশেও ঘটে, আমাদের এখানেও ঘটতেই পারে। কথাটা তারা মিথ্যা বলেননি। কিন্তু তারা সত্য গোপন করেছেন। কিংবা আংশিক সত্য বলেছেন। তাই এখন বোধহয় সময় এটাও বলার যে, বিদেশে সব ধরনের নিরাপত্তার প্রস্তুতি থাকার পরে দুর্ঘটনা ঘটে। আর সেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে ঘটনা ঘটে কিন্তু তার জন্য দায়ীদের উপযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষকে অসহায় করে তুলেছে এবং তারা নিজেদের জন্মস্থানের ওপর আস্থা হারাতে বসেছে।

তাই এখন সময় হয়েছে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে ঘটনার জন্য দায়ী অপরাধীদের চিহ্নিত করা তাদের শাস্তি দেয়া। এক্ষেত্রে আরো বেশিদিন ধরে গড়িমসি করা হলে সেটা হবে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। দেশের জনগণ এখনো বিশ্বাস করতে চায় যে, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হবে তাদের স্বদেশপ্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ।

 

মোহাম্মদ গোলাম নবী: আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার
সাবেক কর্মকর্তা

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন