আমদানি কমছে, ইতিবাচক প্রবণতায় বৈদেশিক বাণিজ্য

অগ্রগতি ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো নিবিড় নজরদারি প্রয়োজন

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সুফল পড়তে শুরু করেছে আমদানি বাণিজ্যে। তথ্য বলছে, জুলাইয়ে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার ৩১ শতাংশের বেশি কমেছে। আগস্টে আরো কমছে। জুলাইয়ের প্রথম ১১ দিনে এলসি খোলা হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলারের। আগস্টের একই সময়ে তা কমে এসেছে ৯৪ কোটি ডলারে। স্বাভাবিকভাবে কমছে আমদানিও। বিরাজমান সংকটের ভয়াবহতা বিবেচনায় এটা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে আমদানি কিছুটা কমলেও সহসাই বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটবে না বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কাজেই চলমান ইতিবাচক ধারা বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো নিবিড় নজরদারি প্রয়োজন।

অনেক দিন ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বিরাজমান। করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরো মাত্রায় সচল হলে রেকর্ড আমদানি হয়। অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয়ে বড় অংকের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে দেশ। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা দেশের রিজার্ভের ওপরও বড় ধরনের চাপ তৈরি করে। রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নেমে আসে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। দেখা দেয় ডলার সংকট। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনমন ঘটায়। ডলার সংকট আরো তীব্রতর করে তোলে। এমন এক প্রেক্ষাপটে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু ব্যবস্থা নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানি খরচ কমাতে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, স্বর্ণসহ ২৭ ধরনের বিলাস পণ্যের এলসিতে শতভাগ মার্জিন নির্ধারণ করে দেয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ কিছু পণ্যের বাইরে অন্য ক্ষেত্রে মার্জিনের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে আমদানিতে ঋণ দেয়ার ওপর আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। এসব উদ্যোগ কার্যকরের ফলে আমদানি কমে আসছে। সামনে প্রবণতা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ।

আমদানি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে কঠোরতা অবলম্বন করেছে, সেটি প্রশংসনীয়। কিন্তু এর জন্য অর্থনীতিতে যেন বড় ধরনের প্রভাব না পড়ে, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের আমদানির অন্যতম অনুষঙ্গ মূলধনি যন্ত্রপাতি শিল্পের কাঁচামাল। স্থানীয় শিল্পে প্রয়োজনীয় অনেক উপকরণই বাইরে থেকে আনা হয়েছে। অতি কঠোরতার কারণে শিল্পের কাঁচামাল আনা বাধাগ্রস্ত হলে দেশের শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যাহত হবে। রফতানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই এটি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। আমদানির আরেক উপাদান ভোগ্যপণ্য। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে হয়েছে। তবে দেশে উৎপাদন হয়েছে, এমন কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানিরও একটা প্রবণতা আমাদের আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে এসব অপ্রয়োজনীয় আমদানি শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা বড় করেছে। আগে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ১২টি পণ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন সে তালিকায় আরো ১৪টি পণ্য যোগ হয়েছে। ফলে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬টিতে। একই সঙ্গে ১২৩টি পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ব্যাপক মাত্রায় বাড়ানো হয়েছে। শুধু তালিকা করে নিষিদ্ধ করলে হবে না, নানা অনিয়মের মাধ্যমে সেগুলো দেশে প্রবেশ করছে কিনা, সেটিও তদারকি করতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এনবিআরকে।

দেশে আমদানি রফতানির মূল্য কম-বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের একটা প্রবণতা বিদ্যমান। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে। পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বিশেষ করে আমদানির ক্ষেত্রে এখন অনেক বেশি ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলছে। পরিস্থিতি ঠিক রাখতে হবে কঠোরভাবে আমদানি তদারক করতে হবে। এখন অবশ্য বড় এলসি নিয়মিতভাবে তদারক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩০ লাখ ডলারের বেশি এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে এলসির দরে সামঞ্জস্যসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে বাংলাদেশ ব্যাংক অনাপত্তি দিচ্ছে। এটা ইতিবাচক। তুলনামূলক ছোট এলসির অসংগতিগুলোও নজরে রাখতে হবে। রফতানির ক্ষেত্রেও বাড়াতে হবে নজরদারি। ঘোষিত রফতানি পণ্যের দর অনুযায়ী অর্থ আসছে না কম আসছে, সেটি নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরের আরো সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

অর্থনীতির জন্য সুখবর, রফতানি আয় রেমিট্যান্সের ধারা এখন ঊর্ধ্বমুখী। তথ্য বলছে, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশের রফতানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১২ শতাংশ বেড়েছে। চলতি আগস্টেও রফতানি রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে খবর মিলছে। বিপরীতে কমছে আমদানি। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ব্যাংকারদের ভাষ্যে উঠে এসেছে, করোনায় স্থগিত থাকা অনেক এলসির মেয়াদ বাড়িয়ে দায় এখন পরিশোধ করা হচ্ছে। আগামীতে এসব এলসির দায় পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে। সুতরাং সাময়িক স্বস্তি কতটা দীর্ঘস্থায়ী  হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা থেকে যায়।

বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা এবং ডলার সংকট মোকাবেলায় সরকারও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। মুহূর্তে খুব বেশি আবশ্যক নয়, এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে। উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানির খরচ সাশ্রয়ে দেয়া হয়েছে নানা নির্দেশনা। বাজারে সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক রফতানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রফতানি আয় আসার একদিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের লাগাম টানতে সম্প্রতি মানি চেঞ্জারগুলোর প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফার সীমা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব নানামুখী পদক্ষেপ নজরদারিতে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা আসবেএটাই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন