রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় সাশ্রয়ের পথ খুঁজছে বিপিসি

প্রাধান্য পাচ্ছে পরিবহন খরচ ও লেনদেনের পদ্ধতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

রুশ একটি কোম্পানি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটিও গঠন করে দেয় সংস্থাটি। কমিটির সদস্যরা এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে পরিবহনসহ আমদানি-সংশ্লিষ্ট ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি লেনদেনের পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে। বিষয়গুলো পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না সংস্থাটি।

জ্বালানি খাতের রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসনেফটের প্রস্তাব পাওয়ার পর গত সপ্তাহে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসে বিপিসি। তত্পরতা চলমান থাকা অবস্থায়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন তিনি। এর পর পরই রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি নিয়ে চলমান তত্পরতা আরো গতিশীল হয়ে ওঠে।

তবে আর্থিক লেনদেনের পদ্ধতি কী হবে, সে বিষয়টি পরিষ্কার না হওয়ায় বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বিপিসি। বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, রুশ কোম্পানি রোসনেফট অয়েলের প্রস্তাবের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। মূলত কী ধরনের পণ্য, সেটি আমদানি করতে লেনদেন জটিলতা, সাশ্রয়ী, কার্গো ভাড়াসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। এগুলোর সমাধান হলে জানা যাবে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বিপিসির জন্য কতটা সাশ্রয়ী হবে।

তিনি আরো বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল ক্রয়ে লেনদেনের মাধ্যম নিয়ে গোটা বিশ্বেই একধরনের জটিলতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশটির কাছ থেকে জ্বালানি তেল ক্রয় করা হলে এর মূল্য কীভাবে পরিশোধ করা হবে, সেটি নিয়ে একটি সমাধানে আসার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে যে সাশ্রয়ী মূল্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটি নিয়েও হিসাবনিকাশ হচ্ছে। এক্ষেত্রে জাহাজ ভাড়া, দূরত্বের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর পরই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে রাশিয়া। একই সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরোধ ক্রমেই বেড়ে চলায় জ্বালানি তেল রফতানির জন্য বিকল্প বাজার খুঁজতে থাকে দেশটি। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে দেশটির পক্ষ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানির প্রস্তাব দেয়া হয় বাংলাদেশকে।

রুশ প্রস্তাবে সরবরাহকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। শিগগিরই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। এরই মধ্যে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে রেকর্ড পরিমাণে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত জ্বালানি তেল ডিজেল লিটারপ্রতি ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। বিপিসির দাবি, এর পরও ডিজেলে লিটারপ্রতি ছয় টাকা করে লোকসান দিতে হচ্ছে।

বিপিসি লোকসানের হিসাব দিচ্ছে আমদানীকৃত ডিজেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য ১৩০ ডলার ধরে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া ডিজেল রফতানি করছে ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের কম মূল্যে (পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে), যা বিপিসির বর্তমান আমদানি ব্যয়ের অর্ধেকেরও কম।

বিষয়ে জানতে চাইলে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. লোকমান বণিক বার্তাকে বলেন, পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া গেলে তা চলমান সংকট মোকাবেলায় বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পণ্যের মান দাম বিবেচনায় রুশ জ্বালানি তেল আমাদের প্রচলিত উৎসগুলোর চেয়ে বেশি সাশ্রয়ী হলে সেটি আমরা অবশ্যই কিনতে আগ্রহী।

বর্তমানে প্রধানত আট দেশ থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করছে বিপিসি। এগুলো হলো কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ভারত।

চলতি বছরের শুরু থেকেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার পরিস্থিতি মারাত্মক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা যাবত্কালের রেকর্ড সর্বোচ্চ। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৯২ ডলারের কিছু বেশিতে। সে হিসেবে গত পাঁচ মাসে পণ্যটির দাম কমেছে ব্যারেলে ৩৭ ডলার।

গত জুনের মাঝামাঝি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম বেড়ে দাঁড়ায় রেকর্ড ১২৫ ডলারে। বর্তমানে সেটি নেমে এসেছে ৮৬ ডলারে। সে হিসেবে গত দুই মাসে ডব্লিউটিআইয়ের ব্যারেলপ্রতি মূল্য কমেছে প্রায় ৪০ ডলার।

বিপিসি মূলত এসঅ্যান্ডপি প্ল্যাটসের প্রকাশিত মূল্য তালিকার ভিত্তিতে বিশ্ববাজার থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির মূল্য নির্ধারণ করে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি সময়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যের সঙ্গে আরো ২০-২৪ ডলার যোগ করে ডিজেল অন্যান্য পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন ডিজেলের দাম ওঠানামা করছে প্রতি ব্যারেল ১১৫-১২০ ডলারে। দেড় মাস আগেও তা ছিল ১৬৫-১৭০ ডলার।

রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানির প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে নিয়মিত বাজারের বাইরে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল কেনা হলে সেটা অবশ্যই জ্বালানি খাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক . ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন অনেক কমে গেছে। অবস্থায় রাশিয়া ঠিক কতটুকু সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি তেল দেবে সেটি বিবেচনার বিষয়। তবে কম দামে তারা জ্বালানি তেল দিলেও সেটি আনতে গিয়ে ঠিক কতটুকু বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী হচ্ছে, সেটি দেখতে হবে। তবে প্রবল সংকটের সময়ে রাশিয়ার জ্বালানি তেল সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া গেলে, সেটি অবশ্যই ভালো হতো।

প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং বৃহৎ জ্বালানি আমদানিকারক দেশ চীন এখন নিয়মিত দামের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম দামে রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করছে। যদিও বাংলাদেশ পরিশোধন সংক্রান্ত জটিলতা মজুদ সক্ষমতার কারণে দেশটির কাছ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ক্রয় করতে পারছে না।

গত মে মাসে রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ। সে সময় বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বাংলাদেশের রিফাইনারিতে পরিশোধনযোগ্য নয়। কারণে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন