২০২২-২৩ অর্থবছর

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আনতে ব্যয় হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা

মেসবাহুল হক

অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ রেখেছে জ্বালানি বিভাগ। তবে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৪৮০ থেকে ৫০০ এমএমএসসিএফ গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৬ কার্গো এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেট্রোবাংলা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ওমান থেকে সেই গ্যাস আনতে মোট ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর সেটি বিক্রি করে পাওয়া যাবে কেবল ১৮ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। ঘাটতির সাড়ে হাজার কোটিরও বেশি টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। সম্প্রতি পেট্রোবাংলার অনুকূলে ভর্তুকির অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগ।

চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। তাই চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৪৮০ থেকে ৫০০ এমএমএসসিএফ গ্যাস সরবরাহের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ৫৬ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হবে। এর মধ্যে কাতার থেকে ৪০টি এবং ওমান থেকে আনা হবে ১৬টি কার্গো। তবে এলএনজির সর্বশেষ ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল মূল্যের ফিউচার মার্কেট থেকে পাওয়া মাসভিত্তিক মূল্যহারের ভিত্তি এবং ডলারের বিনিময় হার ৯৪ টাকা ৭৫ পয়সা ধরে এলএনজি আমদানি খাতে আর্থিক ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় হাজার ৬৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

এলএনজি আমদানির খাতভিত্তিক ব্যয় তুলে ধরে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুটি থেকে ৫৬টি কার্গো গ্যাস কেনা বাবদ ব্যয় হবে ২২ হাজার ৩৬৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। রিগ্যাসিফিকেশন বাবদ ব্যয় হাজার ৬৯৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, এটকস্ট ব্যয় ৯৬ কোটি, ভ্যাট এআইটি (অগ্রিম কর) বাবদ পরিশোধ করতে হবে হাজার ৮০২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ব্যয় দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৯৬৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭৫ পয়সা ধরে) সেই এলএনজি বিক্রি করে আয় হবে ১৮ হাজার ৩২১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ আয়-ব্যয়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে হাজার ৬৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। তাই দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এলএনজির সুষ্ঠু নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অব্যাহত রাখতে চলতি অর্থবছরে সেই অর্থ পেট্রোবাংলার অনুকূলে ভর্তুকি দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। চিঠিতে এও বলা হয়েছে, প্রয়োজনে যদি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ক্রুড অয়েলের মূল্য হ্রাস বা বৃদ্ধি এবং ডলারের বিনিময় হার ওঠানামা করলে সে অনুসারে ঘাটতির হিসাবও পরিবর্তিত হবে। 

পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া এবং এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় গ্যাস আমদানিতে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় সার্বিকভাবে খাতে ভর্তুকি কমে আসবে। এছাড়া ঘাটতি কমিয়ে আনতে স্থানীয় উৎস থেকেও গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এর পরও যদি প্রয়োজন হয় এবং বিশ্ববাজারে দাম কমে, তাহলে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে জানান, তাদের চাহিদার কথা অর্থ মন্ত্রণালয়কে তারা জানিয়েছেন। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এখনো তাদের অনুকূলে কোনো অর্থ ছাড় করেনি অর্থ বিভাগ। অবশ্য খুব শিগগিরই প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন বলেও জানান তিনি। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ফিউচার মার্কেটে এলএনজির দাম বাড়ায় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় চলতি অর্থবছরে খরচ কিছুটা বাড়লেও স্পট মার্কেট থেকে আমদানি না করায় সার্বিকভাবে ভর্তুকি কমবে। তবে ভর্তুকি আরো কমিয়ে আনতে এখন স্থানীয় গ্যাসকূপের দিকে ব্যাপকভাবে জোর দেয়া হচ্ছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটে এলএনজি আমদানি খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আগের হিসাব মাথায় রেখে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস সঞ্চালন করা হয় তার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ এলএনজি। দীর্ঘমেয়াদি স্পট মার্কেট দুটি উৎস থেকে পরিমাণ গ্যাস কিনতেই সংস্থাটিকে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানিকারক দেশগুলোর বিল প্রক্রিয়াজাতসহ মোট খরচ করতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এলএনজি আমদানিতে অর্থ ব্যয়ের একটি তুলনামূলক ব্যাখ্যা দিয়ে পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, গত অর্থবছরের সময়ে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজির প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিটের (এমএমবিটিইউ) দাম ছিল -১০ ডলার, বর্তমানে তা ১৪-১৫ ডলার। একই সময়ে স্পট মার্কেটে দাম ছিল ২০-২৫ ডলার, বর্তমানে তা ৪২-৪৪ ডলার। ফলে দুই উৎস থেকেই আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।

দেশে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট এবং স্পট মার্কেট থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আনার পরিকল্পনা হয়। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ওমান থেকে গ্যাস আমদানি করা গেলেও উচ্চমূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। আগামীতে খোলাবাজার থেকে পণ্যটি আমদানি করা যাবে কিনা, তারও নিশ্চয়তা নেই। ফলে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় এলএনজির অস্থিতিশীল বাজার ব্যাপক হারে প্রভাব ফেলেছে। এর জন্য সরকারের আমদানিনির্ভরতাকেই দায়ী করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনায় জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ কমেছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অবস্থায় স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এরই মধ্যে কয়েকটি কূপের সংস্কারকাজ (ওয়ার্কওভার) শেষ হয়েছে। সংস্কার চলে আরো কিছু কূপের। নতুন করে খনন করা হচ্ছে আরো প্রায় দেড় ডজন কূপ। পেট্রোবাংলাসহ দেশের জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, এসব উদ্যোগ সফল হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ বাড়বে আরো অন্তত ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন