ডলারের বাজার অস্থিরতার পরোক্ষ প্রভাব পুঁজিবাজারেও

মেহেদী হাসান রাহাত

গত বছরের জুনেও দেশের বাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকার ঘরে ছিল। এর পর থেকে তা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে গত তিন মাসে ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা গিয়েছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে গত বছরের অক্টোবরের পর থেকেই দেশের পুঁজিবাজারে নিম্নমুখিতা দেখা যাচ্ছে, যা আরো তীব্র হয়ে ওঠে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা পুঁজিবাজারে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ ২০২১ সালের জুন শেষে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। গত এপ্রিলে তা দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায়। মে মাসে এটি আরো বেড়ে হয় ৮৯ টাকা। জুন শেষে প্রতি ডলারের বিনিময় হার দাঁড়ায় ৯৩ টাকা ৪০ পয়সায়। গত মাসের শেষে এটি ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৯৫ টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত কার্ব মার্কেটে ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিনিময় মূল্যের চেয়ে - টাকা বেশি ব্যবধানে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু সংকট তীব্র হতে হতে বর্তমানে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৯-১২০ টাকায়।

দেশের পুঁজিবাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের অক্টোবর থেকেই পুঁজিবাজার নিম্নমুখী। ওই সময়ের পর থেকে একের পর এক নানা ইস্যুতে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাজার ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মতপার্থক্য কভিডের নতুন ধরন ওমিক্রন গত বছরের শেষ প্রান্তিকে বিনিয়োগকারীদের চিন্তিত করে তুলেছিল। বছরের প্রথম প্রান্তিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শ্রীলংকার আর্থিক দুরবস্থার বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে তোলে। এর মধ্যে চলতি বছরের বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা থাকবে এমন প্রত্যাশা ছিল বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার গুরুত্ব দেয়া হলেও পুঁজিবাজারের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না।

সার্বিকভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। এতে পণ্য আমদানিতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়, যার কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতিও বাড়তে থাকে। সর্বশেষ টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করায় অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। ডলারের বাড়তি দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে থাকে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। সামষ্টিক অর্থনীতির এসব চ্যালেঞ্জের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এতে প্রতিদিনই বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ঈদুল আজহার ছুটির পর থেকেই ধারাবাহিক নিম্নমুখিতা দেখা যায় পুঁজিবাজারে।

ব্যয় কমাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে ঘোষণা আসার পর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতির গভীরতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পান। এতে পুঁজিবাজার নিয়ে তাদের আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। অবস্থায় যেকোনোভাবে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে পুঁজি উঠিয়ে নেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। কোনো শেয়ার কেনার আদেশ এলেই একসঙ্গে অনেক বিনিয়োগকারীকে বিক্রির আদেশ দিতে দেখা যায়। ধরনের পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের কঠিন স্নায়ুচাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অবস্থায় দরপতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে শেয়ারদরের সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দেয় বিএসইসি। কিন্তু তার পরও গত সপ্তাহে নিম্নমুখী ছিল পুঁজিবাজার।

গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূূচক ডিএসইএক্স সর্বোচ্চ হাজার ৩৬৮ পয়েন্ট থেকে কমে গত ২৮ জুলাই ছিল হাজার ৯৮০ দশমিক ৫১ পয়েন্ট। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সূচকটির অবস্থান দাঁড়িয়েছে হাজার ১৪৮ দশমিক ৭৭ পয়েন্টে।

বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি রোজারিও বণিক বার্তাকে বলেন, পুঁজিবাজারে ডলারের দাম বাড়ার পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। একদিকে রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো ডলারের দাম বাড়ার কারণে সুবিধা পাবে। অন্যদিকে যেসব ব্যবসা আমদানিনির্ভর তারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ার প্রভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে মুনাফা কমে যাবে। তবে ডলারের দাম একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে এলে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের দাম সমন্বয় না করার কারণে তিন বছর ধরেই পুঁজিবাজারে নিট বিদেশী বিনিয়োগ নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। সময়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন তার চেয়ে বেশি বিক্রি করেছেন। বাজার মূলধনের অনুপাতে পুঁজিবাজারে বিদেশীদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ শতাংশের কম হলেও এর মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। তাছাড়া পোর্টফোলিও এবং উদ্যোক্তা পরিচালকদের বিনিয়োগ মিলিয়ে পুঁজিবাজারে মোট বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ বাজার মূলধনের ১৮-২০ শতাংশ হবে। টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে ডলারের দামে বেশি অস্থিরতা দেখা গেলে তখন বিদেশীরা লোকসানের শঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করা কমিয়ে দেন। এর বিপরীতে ডলারের দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে পুঁজিবাজারে নতুন করে বিদেশীদের বিনিয়োগ বাড়বে। এতে বাজারে গতিশীলতা ফিরে আসবে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।

ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, কাঁচামাল সুদহার বাড়ার পাশাপাশি পণ্য জাহাজীকরণের উচ্চব্যয়ের কারণে ব্যয় বৃদ্ধির চাপে রয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো। এতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দুই বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশের চলতি ২০২২ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির চাপে কোম্পানি দুটির মুনাফার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গার বাংলাদেশের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। আর হাইডেলবার্গ সিমেন্টকে লোকসান গুনতে হয়েছে। তালিকাভুক্ত অন্যান্য কোম্পানির ওপরও কমবেশি ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। চলতি প্রান্তিকের আর্থিক ফলাফলে এর প্রভাব প্রতিফলিত হবে। তার ওপর সম্প্রতি জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ানোর ফলে চাপ আরো তীব্র হবে। ব্যয় বৃদ্ধির চাপে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও সংকুচিত হয়ে আসছে। এতে ভোক্তা পর্যায়ে ভোগের পরিমাণও কমে যাবে, যা প্রভাব ফেলবে কোম্পানির পণ্য বিক্রির ওপর।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান . এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পাশাপাশি জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে পণ্য পরিবহন খাতে ব্যয় বাড়বে। মূল্যস্ফীতির উচ্চহার, রফতানির কার্যাদেশ কমে যাওয়া এবং বিদ্যুৎ সংকটের মতো বিষয়গুলোও বিনিয়োগকারীদের মনে শঙ্কা তৈরি করছে। অবস্থায় কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে যাওয়ার পাশাপাশি লভ্যাংশ নিয়েও তারা সন্দিহান। সব মিলিয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ দেখা যাচ্ছে।

বিনিয়োগ ব্যাংকাররা বলছেন, ঐতিহাসিকভাবে মুদ্রাবাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলে পুঁজিবাজার ম্রিয়মাণ থাকে। অন্যদিকে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী হলে মুদ্রাবাজার নিম্নমুখী থাকে। ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার ছেড়ে টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুদ্রানীতিতে তারল্য সরবরাহে লাগাম টেনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সার্বিকভাবে মুদ্রাবাজারে তারল্য সরবরাহ কমে গিয়েছে, যার প্রভাবে সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হচ্ছে কল মানি মার্কেটে। এতে ঋণের সুদহারও বেড়েছে। পুঁজিবাজারে ডলারের দাম বাড়ার প্রত্যক্ষ প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে নিট মুনাফা কমে যাওয়া। আর পরোক্ষ প্রভাব হচ্ছে ডলারের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। পাশাপাশি বাড়তি ব্যয় মেটাতে অনেকে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করতে শুরু করেন। এতে পুঁজিবাজারসহ অন্যান্য খাতে মানুষের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়।

দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অধিকাংশই ব্যক্তিশ্রেণীর। ফলে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বাড়লে পুঁজিবাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়ে। শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের অনেকেই নিজেরা বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেন না। বরং ব্যক্তিশ্রেণীর বড় বিনিয়োগকারীরা কোথায় বিনিয়োগ করেন সেটি অনুসরণ করেন। বাজারে জোর গুঞ্জন রয়েছে বেশকিছু ব্যক্তিশ্রেণীর বড় বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে বেশি মুনাফার প্রত্যাশায় ডলার কিনে রাখছেন। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি থাকায় প্রবাসীদের অনেকেই ব্যাংকের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাচ্ছেন। অন্যদিকে পুঁজিবাজার বর্তমানে নিম্নমুখী থাকায় খাতে প্রবাসীদের বিনিয়োগও কমে গিয়েছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, অনেকেই লাভের আশায় ডলার ধরে রাখার জন্য কিনে রাখছে বলে মনে হচ্ছে। এজন্য ডলারের বাজারে সংকট বেড়েছে। সরকার এটি তদন্ত করে দেখতে পারে। আরেকটি বিষয় হতে পারে প্রবাসীরা ডলারের দাম আরো বাড়ে কিনা সেজন্য অপেক্ষা করে বর্তমানে দেশে সেভাবে টাকা পাঠাচ্ছে না। কিংবা যারা পাঠাচ্ছে তারা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। এতেও বাজারে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, চলতি হিসাবে ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি ডলারের দামে অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ চিন্তিত। পুঁজিবাজারের বেশকিছু বিনিয়োগকারীর মধ্যে ডলারের বাজার স্থিতিশীল না হলে আপাতত দূরে থেকে বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করারও প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন