চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৪০ বছর আগে পাহাড় ছিল ২০০টি, যার ৬০ শতাংশই আজ বিলুপ্ত। ১৯৭৬ সাল থেকে নগরী ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেছে স্বয়ং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এছাড়া দখল, দূষণ, ভরাট, চর জাগা ও পরিকল্পিত ড্রেজিং না করায় ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে দেশের অন্যতম প্রধান নদী কর্ণফুলী, হালদা ও সাঙ্গু। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান বলেন, গত দুই যুগে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমিদস্যুরা গ্রামে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং শহরে ৬০ শতাংশ পাহাড় কেটে ধ্বংস করে ফেলেছে। সেই সঙ্গে এসব পাহাড়ে গড়ে তুলেছে হাজার হাজার অবৈধ ঘরবাড়ি।
২০১১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার, মতিঝরনা, ষোলশহর ও ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ সাল থেকে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক শূন্য ২ বর্গকিলোমিটারে। অর্থাৎ ওই সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়েছে, যা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে। স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়েছে। একই সময়ে আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি। এর পরের ১২ বছরে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার নিয়েছে। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাহাড় নিধন।
জঙ্গল সলিমপুরসহ চট্টগ্রামের সব পাহাড় সংরক্ষণ ও নদী রক্ষার দাবিতে আয়োজিত গতকালের সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, শহরের অতি নিকটে জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকা। এখানে সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় ছিল ৩ হাজার ১০০ একর। কিন্তু গত দুই যুগের মধ্যে ৪০-৫০ জনের চিহ্নিত ভূমিদস্যু বাহিনী চট্টগ্রামের এ এলাকার পাহাড় কেটে আলাদা এক সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। গড়ে তুলেছে দেশের ভেতরে আরেক দেশ। তাদের সহযোগী হিসেবে আছে আরো অন্তত ৩০০ জন দখলদার। ২০০০ সাল থেকে যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, এ ভূমিদস্যুরা তখন সে দলের ব্যানার টাঙিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করেছে। তারা প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষের কাছে ভাড়া কিংবা দখল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
জানা গিয়েছে, জঙ্গল সলিমপুরে আট হাজার পরিবারে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। তবে সম্প্রতি আদমশুমারিতে ১৯ হাজার মানুষের তথ্য মিলেছে। ওই এলাকায় থাকতে হলে সমিতির সদস্য হতে হতো। মেনে চলতে হতো সমিতির নিয়ম-কানুন। কাজের সুবিধার্থে তাই পুরো এলাকাকে ১১টি ‘সমাজে’
ভাগ করা হয়েছে। কোথায় কোন পাহাড় কাটা হবে, কোন সড়ক তৈরি হবে, কখন কে সরকারি সাহায্য পাবে, তা নির্ধারণ করেন সমাজগুলোর শীর্ষ ১১ ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে, মশিউর ও সাদেকের সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলেন ওই ১১ জন।
পাহাড় কাটায় জড়িতদের গ্রেফতারসহ সাত দফা দাবি পেশ করে আলিউর রহমান বলেন, আমরা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে জঙ্গল সলিমপুর ও আলিনগরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে গড়ে তোলা সব অবৈধ বসতি দ্রুত উচ্ছেদ করার জোর দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে ভূমিহীনদের যেভাবে জায়গাসহ ঘর উপহার দিচ্ছেন সেই নিয়মে চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করা প্রকৃত ভূমিহীনদের ঘরসহ পুনর্বাসনের দাবি জানাই।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পাহাড় হচ্ছে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় খুঁটির মতো, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিহতের পাশাপাশি মানুষ এবং জীববৈচিত্র্যের সুপেয় পানির আধার। ক্রমাগত পাহাড় ধ্বংস হয়ে গেলে চট্টগ্রাম মহানগরী পরভূমিতে পরিণত হবে। ক্রমবর্ধমান ইট কংক্রিটের সৃষ্ট উত্তাপ পরিশোধন করার বিকল্প না থাকায় নগরীর তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। পাহাড় কেটে আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন করে মানুষ যতটুকু আর্থিক লাভবান হচ্ছে, বাস্তবে প্রাকৃতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।
দেশের অর্থনীতির হূিপণ্ড কর্ণফুলী নদীর দুই পারে অবৈধভাবে গড়ে তোলা সব স্থাপনা উচ্ছেদেরও জোর দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। চট্টগ্রাম শহরের শত শত টন বর্জ্য ও পলিথিন যাতে কর্ণফুলীতে পড়তে না পারে সে বিষয়ে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণেরও অনুরোধ জানানো জয়। সেই সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক মত্স্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর মা মাছ রক্ষা, দূষণ রোধ এবং বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এবং আরএস শিট অনুসারে চট্টগ্রাম শহরের ৭২টি খাল চিহ্নিত করে বিলুপ্ত এবং দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধারের দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মোজাম্মেল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সভাপতি চৌধুরী ফরিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।