ফিরে দেখা

স্বাধীনতা-উত্তর মূল্যস্ফীতি ও তা প্রতিরোধে নেয়া পদক্ষেপ

তানিম আসজাদ

সময়টা ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। রক্তস্নাত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ যাত্রা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। সম্বল বলতে দুর্বল কৃষি খাত আর ১৯৭১ সালের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট, রেললাইন, সেতু তথা ভৌত অবকাঠামো। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বেশির ভাগই গরিব নিরক্ষর। অদক্ষ জনশক্তি আর অপ্রতুল সম্পদ নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার মতো দুরূহ কাজে হাত দেন বঙ্গবন্ধু তার সহযোগীরা। বেশির ভাগেরই দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা দূরে থাক, দেশ পরিচালনাবিষয়ক জ্ঞান ধারণাও ছিল সীমিত।

মনে রাখা দরকার, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি আর এক কোটি লোকের উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার মতো ঘটনাগুলোর দুঃসহ তরতাজা স্মৃতি তখন দেশকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শরণার্থীরা দেশে ফিরে আসার পর পুনর্বাসনসহ দেশের ভেতরে ভুক্তভোগী আরো কয়েক কোটি মানুষকে দুই বেলা খাওয়ার জোগান দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ তখন নেই। রাষ্ট্রীয় কোষাগারও শূন্য, যা পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করেছিল। এসব কঠিন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় বিশৃঙ্খলা আর সহিংসতা বেড়ে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি। মাথাচাড়া দেয় কথিত বিভিন্ন বিপ্লবী দল। ফলে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে প্রবল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় একেবারে শুরু থেকে। দেশ গঠন পরিচালনার কাজ শুরু করতে হয় অনেকটা নিঃস্ব অবস্থায়, যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে অত্যন্ত কঠিন করে দেয়। রাজনৈতিক প্রশাসনিক সক্ষমতাও ভেঙে পড়ে। তখনকার পরিস্থিতি নির্মোহভাবে বিচার করলে এটা বলা অত্যুক্তি হয় না, একটি অভিজ্ঞ যোগ্য সরকার থাকলেও তার পক্ষে এত প্রতিকূলতা সামাল দেয় খুব সহজ হতো না। তার পরও যুদ্ধোত্তর পুনর্বাসনের কাজ বঙ্গবন্ধু সরকার সীমিত সম্পদ দিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিল, যা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে।

এটাও অনস্বীকার্য ১৯৭২-৭৫ সময়কালের তিন বছর আট মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি একের পর এক অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক আঘাতে ধুঁকতে থাকে। সময়কালে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের সংকট দেশে চোরাচালানের ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়; বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্য কমে যায়, কমে যায় বিদেশী সাহায্য, বিশেষ করে খাদ্য সাহায্য, দেশের ভেতর দেখা দেয় খরা (১৯৭২), ঘূর্ণিঝড় (১৯৭৩), বন্যা (১৯৭৪) দুর্ভিক্ষ (১৯৭৪) এর মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যাংক-বীমা, কল-কারখানা ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত ব্যাপক জাতীয়করণের দিকে অগ্রসর হওয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়। তত্কালে মূল্যস্ফীতির প্রবল যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তার অন্যতম বড় নিয়ামক ছিল জাতীয়করণ।

মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চাপ

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মূল্যস্ফীতি অন্যতম বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৭২-৭৫ সময়কালে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪০ শতাংশ। বছরওয়ারি হিসাবে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪১ শতাংশ, যা ১৯৭৪-৭৫ সময়কালে বেড়ে গিয়ে হয় ৭০ দশমিক ২০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কেন হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে একটি জোরালো মত হলো, সময়কালে বাজারে টাকার সরবরাহ অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল, যা মূল্যস্ফীতির হারকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রায় নিঃস্ব দেশে নগদ টাকার সরবরাহ বাড়ালে তা মূল্যস্ফীতিকে বাড়াবে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি শূন্য কোষাগার নিয়ে দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। শরণার্থী পুনর্বাসন, অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ, নিত্যপণ্য জোগানসহ নানা কাজে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে সরকারের হাতে বিকল্প ছিল খুবই কম। অর্থবাজার বা জনগণের কাছ থেকে বন্ড ছেড়ে ঋণ নেয়ার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। আবার বিদেশী সহায়তা এলেও তা বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এসব প্রয়োজন মেটাতে সরকারকে টাকা ছাপানোর দিকে যেতে হয়েছিল। আবার কলকারখানা জাতীয়করণ করায় সেগুলোর পরিচালন ব্যয় মেটাতে টাকার চাহিদা বেড়ে যায়। এজন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। বিপরীতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর উৎসগুলো তখনো সীমিত। ট্যাক্স বা কর আদায়ে জোর দেয়ার মতো সক্ষমতা অবস্থা কোনোটিই তখন সরকারের ছিল না। ফলে টাকা ছাপিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর পথেই হেঁটেছিল সরকার।

পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে মুদ্রা সরবরাহ ৭১ দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছিল। তবে ১৯৭৩ সালের জুন শেষে হার হয় ৪১ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা ওই বছর ডিসেম্বর শেষে নেমে আসে ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশে। পরের বছর ১৯৭৪ সালের জুন মাস শেষে এটি প্রায় অপরিবর্তিত থাকে ২৩ শতাংশে এবং ডিসেম্বর শেষে হয় ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। তবে ১৯৭৫ সালের জুন শেষে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় মাত্র দশমিক ৮০ শতাংশ, যা ডিসেম্বর মাসে আরো কমে হয় দশমিক ৯০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ এমএ তসলিম তার এক নিবন্ধে [তসলিম, ১৯৯৮] পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন যা দেখায়, বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথমদিক মুদ্রা সরবরাহ যেভাবে বেড়েছিল, তা আর পরের দিকে হয়নি বরং অনেকটা দ্রুততর কমে যায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদকৃত পরিসংখ্যানে [মান্থলি ইকোনমিক ট্রেন্ডস: টাইম সিরিজ ডাটা সিন্স ১৯৭২] ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছর থেকে মুদ্রা সরবরাহের উপাত্ত পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছিল মাত্র দশমিক ২২ শতাংশ।

মূল বিষয়টা হলো ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে মুদ্রা সরবরাহ যথেষ্ট কমে এসেছিল বা কমিয়ে আনা হয়েছিল যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল মূল্যস্ফীতির ওপর, তবে তা বেশ সময় নিয়ে। বরং বলা যায়, অতিপ্রভাব পড়েছিল। আর তাই ১৯৭৫-৭৬ সময়কালে মূল্যস্ফীতির বদলে মূল্যসংকোচন দেখা দেয় এবং হার হয় ২৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে ১৯৭৬-৭৭ সময়কালে মূল্যসংকোচন হার অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, যা হয় দশমিক ৩০ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতি বা মূল্যসংকোচনের হিসাবটা মোট দেশজ আয় সংকোচক বা জিডিপি ডিফ্লেটরের ভিত্তিতে নির্ণীত। কেননা, এখানে একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রথম দশকে মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়টা এখনকার মতো ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) ধরে করা হতো না। সে সময় ব্যবহার করা হতো জীবনযাত্রার ব্যয় সূচক (সিএলআই) এবং জিডিপি ডিফ্লেটর। আর ভিত্তিবছর ছিল ১৯৭৩-৭৪। সিএলআই ভিত্তিতে অবশ্য ১৯৭৩-৭৪ সালের মূল্যস্ফীতির কোনো হিসাব করা সম্ভব হয়নি। এটা শুরু হয় ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর থেকে আর সে বছরই বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি (সিএলআইভিত্তিক) হয় ৬৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। পরের বছরই মূল্যসংকোচন দেখা দেয় যার গড় হার ছিল দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর পরের বছর বা ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার হয় দশমিক ৪২ শতাংশ। উল্লেখ্য, এর পর থেকে বাংলাদেশে আর কখনই মূল্যসংকোচন হয়নি।

একইভাবে সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ২৩৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা থেকে প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়ে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ৩৭৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা হলেও ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে তা মাত্র ১৪ শতাংশ বেড়ে হয় ৪২৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর পরের অর্থবছরও ১৫ শতাংশ হারে বেড়ে হয় ৪৯১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। পরিসংখ্যান আরো দেখায়, অর্থনীতিতে নগদ টাকার ভিত্তি (ক্যাশবেইজ) ১৯৭২-৭৩ সালে ছিল ৩৭১ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা পরের অর্থবছর প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়ে হয় ৪১৯ কোটি টাকা। কিন্তু পরের বছরই সরকার তা শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল।

মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির যে শেষ ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। যেমন ১৯৭২ সালে যেখানে প্রতি মণ চালের দাম গড়ে ছিল প্রায় ৭০ টাকা, তা ১৯৭৫ সালে হয় প্রায় ১৮৫ টাকা। পরের বছর তা নেমে আসে ১৩৩ টাকায়। একইভাবে ১৯৭২ সালে মণপ্রতি লবণ ১৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৭৫ সালে ১১০, গম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ২৩০ এবং আটা ৩৩ টাকা থেকে বেড়ে ৫৫ টাকায় উঠেছিল। উৎপাদন ব্যাহত হওয়া আমদানি ব্যয়বহুল হওয়ার পাশাপাশি বিদেশী সহায়তা কমে যাওয়ায় সরবরাহজনিত যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়, তা বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। সত্তরের দশকের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে এশিয়া আফ্রিকার কয়েকটি দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বাণিজ্যিকভাবে খাদ্য আমদানি বাংলাদেশের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। তাই ১৯৭৩-৭৪ সালে খাদ্য আমদানি ব্যাপক কমে যায় বৈদেশিক মুদ্রাস্বল্পতার জন্য। আবার একই সময়ে খাদ্য সাহায্য হ্রাস পায়। বিশেষত কিউবায় পাটের থলে রফতানিতে ক্ষুব্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রতিশ্রুত খাদ্যসহায়তা আটকে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চোরকারবার মজুদদারি। এগুলোর প্রতিফলন ঘটেছিল মূল্যস্ফীতিতে।

ওই সময়টায় বিশ্বজুড়েই টালমাটাল অবস্থা চলছিল। আরব-ইসরাইল সংঘাতের জের ধরে প্রথম জ্বালানি তেল সংকট দেখা দেয় ১৯৭৩ সালে, যা পরিস্থিতিকে গুরুতর করে তোলে। ফলে জাপান, নিউজিল্যান্ড, স্পেনের মতো উন্নত এবং ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো কম-বেশি মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়েছিল বা বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭২ সাল বাদ দিলে পরের তিন বছর বাংলাদেশের মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার মোটামুটি এসব দেশের মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হারের মতো বা এসব দেশের চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল। যেমন১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের বার্ষিক মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার ছিল ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। একই বছর থাইল্যান্ডে হার ছিল ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, জাপানের ১৩ দশমিক ১০ নিউজিল্যান্ডে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় গড় হার ছিল ১৯ দশমিক ৪০ আর উন্নয়নশীল বিশ্বে ৩০ দশমিক ৯০ শতাংশ

যে কারণেই মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো হোক না কেন, তা পরিণতিতে মূল্যস্ফীতি ডেকে আনতে বাধ্য যদিও সেই মূল্যস্ফীতির হার দেশভেদে ভিন্ন হবে। তাত্ত্বিকভাবে বাজারে যখন টাকা বা মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায় বা মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, তখন বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়ে বিভিন্ন পণ্য সেবার দাম বাড়ে, যা সার্বিক মূল্যস্তর বাড়িয়ে দিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটায়। আবার যখন মুদ্রার সরবরাহ কমে আসে, তখন চাহিদাও কমে যায় এবং তার প্রভাবে দাম তথা মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হয়। মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোকে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি আর কমানোকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বলা হয়। তবে সংকুলানমুখী (অ্যাকোমোডেটিভ) মুদ্রানীতিও মূল্যস্ফীতি ঘটাতে পারে যদি তা মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা তৈরি করে। এসব বিবেচনায় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম দুই বছরে প্রথমার্ধে মুদ্রা সরবরাহ যে অনেক বাড়ানো হয়েছিল আর তা যে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছিল, তা নিয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। তবে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার ১৯৭৩ সালের পর দ্রুত কমে এলেও মূল্যস্ফীতির হার একইভাবে নিম্নমুখী হয়নি বরং কিছুটা সময় লেগেছে, যা অর্থনীতির ভাষায় বলে ল্যাগ ইফেক্ট বা প্রলম্বিত প্রভাব। বস্তুত ১৯৭২-৭৩ সালের উচ্চ হারে টাকার সরবরাহ বৃদ্ধির পরিণতিতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যাওয়ায় জনমনে আশঙ্কা দেখা দেয়, সামনে হয়তো জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে; যাকে মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা বলা যায়। আর তাই মুদ্রা সরবরাহের হার কমে গেলেও বাজারে বাড়তি টাকার প্রবাহ অনেকটাই বজায় ছিল, যা ১৯৭৪ সালেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঘটাতে ভূমিকা রাখে।

মুদ্রা সরবরাহে রাশ টানার জন্য ১৯৭৪ সালের জুন মাসে ব্যাংক হার শতাংশ থেকে বাড়িয়ে শতাংশ করা হয়। আর ১৯৭৫ সালে প্রায় ৫৭ শতাংশ হারে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো হয় ডলারের বিপরীতে। আর তার আগে ১০০ টাকার নোট বাতিল করার মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এসব পদক্ষেপ শুধু মুদ্রা সরবরাহ কমাতেই নয়, চোরাকারবার মজুদদারি নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশেষত রফতানিতে প্রতিযোগিতাসক্ষমতা সৃষ্টির প্রয়াস থেকে নেয়া হয়েছিল।

লক্ষণীয়, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছিল মাত্র শতাংশ, যেখানে শিল্পোন্নত বিশ্বে এর গড় বৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ২০ শতাংশ। চিত্র বিবেচনায় নিলে এটা মনে করা অযৌক্তিক হবে নাযুদ্ধবিধ্বস্ত, গরিব মানুষ অধ্যুষিত, অদক্ষ জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর প্রথম সাড়ে তিন বছরে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় খুব খারাপ করেনি। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ সংকটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিকূল পরিস্থিতিরও শিকার হয়েছিল তখন বাংলাদেশ।

লক্ষণীয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুকূলে আসতে শুরু করে। একদিকে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে, অন্যদিকে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম কমে আসে, যা আমদানি ব্যয় কমিয়ে দেয়। সর্বোপরি অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। পরবর্তী সরকার অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। আর তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রথম সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু সরকার কীভাবে একের পর এক অভ্যন্তরীণ বৈশ্বিক ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল এবং মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, তা বর্তমানে তো বটে, ভবিষ্যতের জন্যও গবেষণার একটি দারুণ বিষয় হয়ে থাকবে। 

 

তানিম আসজাদ: লেখক সাংবাদিক

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন