তাপ শোষণের জন্য পর্যাপ্ত পুকুর নেই রাজধানীতে

২৪১ পুকুর সংরক্ষণে উদ্যোগ নেই

আল ফাতাহ মামুন

রাজধানীর রায়েরবাজারের শেরেবাংলা রোডের পটারি পুকুর ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

রাজধানীর অনেক সমস্যার মধ্যে একটির নাম জলাবদ্ধতা। সেই সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে দাবদাহ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ রাজধানীর পুকুর জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া। আগে যে পরিমাণ তাপ জলাধার পুকুর শোষণ করে নিত সেটা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও রাজধানীর ছোট-বড় পুকুরগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

রাজধানীর পোস্তগোলার বাসিন্দা মো. মাসুদ। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরও। তার বাড়ির পাশেই ছিল পোস্তগোলা পুকুর। তার শৈশব কেটেছে পুকুরে সাঁতার কেটে, নৌকা বেয়ে। ছোটবেলার স্মৃতিমাখা সেই পুকুরটি ভরাট হয়ে গেছে বছর দশেক হলো। তিনি বলেন, শুধু সেটিই নয়। এলাকায় বেশ কয়েকটি পুকুর ছিল। এখন তুলাবাগিচা নামে যে এলাকাটি রয়েছে, তার পুরোটাই ছিল বিশাল পুকুর। হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরির পেছনেও একটি পুকুর ছিল। তবে এগুলো ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে ভরাট গিয়েছে গেছে পুকুরগুলো।

পোস্তগোলার পার্শ্ববর্তী মুরাদপুর এলাকায় ছিল দুটি ছোট পুকুর। পাশের এলাকা দোলাইরপাড়ে দুটি বড় গেন্ডারিয়ায় অন্তত চারটি বড় পুকুর ছিল। এর মধ্যে মাত্র দুটি পুকুর এখনো টিকে আছে। বাকিগুলো হারিয়েছে নগরায়ণের চাপে।

২০২০ সালে রাজধানীর পুকুর নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ এজাজ বণিক বার্তাকে জানান, সেই সময়ে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৪১টি পুকুর আমরা পেয়েছিলাম। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন।

সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকার কারণে খুব দ্রুত ঢাকার পুকুর জলাশয় হারিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত দুই বছরে হয়তো অনেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো এসব পুকুর সংরক্ষণের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

জনভারে নুয়ে পড়া রাজধানীকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাজউক ঢাকা মহানগর এলাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-২০৩৫ (ড্যাপ) নামে একটি মাস্টার প্ল্যান করে। প্রকল্পটির পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ঢাকা সিটি সিটির বাইরে ৫০০টির বেশি পুকুর পেয়েছি। বেসরকারি পুকুর তো বটেই, সরকারি বহু পুকুরও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ঢাকাকে পরিবেশসম্মত বসবাসের উপযোগী শহর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুকুরগুলো সংরক্ষণের বিকল্প নেই।

রাজধানীর অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দাবদাহও একটি ভয়ানক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিন দিন রাজধানীর পুকুর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। আগে যে পরিমাণ তাপ জলাধার পুকুর শোষণ করে নিত সেটা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে রাজধানীতে বসবাসরতদের জনজীবন হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছে। সমস্যা সমাধানে সরকারি বেসরকারি পুকুরগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালকও।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি নগরে পুকুর, দিঘি বা ধরনের জলাশয় বহু কারণে থাকা জরুরি। পুকুরে জলচর, স্থলচর, উভচর প্রাণীই বসবাস করতে পারে। পোষা বন্য প্রাণী খুব ভালোভাবে আবাসস্থল গড়ে তুলতে পারে। আর আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সব ধরনের প্রাণীর সামঞ্জস্যপূর্ণ বসবাসের পরিবেশ থাকাটা খুবই দরকার। পুকুরের পানি অনেক ধরনের পরিবেশবান্ধব গাছপালা জীবজন্তুর জীবনপ্রণালিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ছাড়াও অগ্নিকাণ্ডের সময় পানির সংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পুকুর-দিঘির মতো জলাশয়ের একটা অনন্য ভূমিকা রয়েছে। একসময় এসব পুকুর দিঘি সুপেয় পানির উৎস হিসেবে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ক্রমবর্ধমান নগরায়ণে প্রাণবৈচিত্র্য এবং জনজীবনের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ভরাট করা আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সে আইনের কোনো প্রয়োগ না থাকায় ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে ঢাকার পুকুরগুলো। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫- স্পষ্ট বলা আছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাশয় পুকুর ভরাট করা যাবে না। সম্প্রতি উচ্চ আদালতও সম্পর্কে একটি রায় দিয়েছেন। সেখানেও একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশে এখন এত পরিমাণে নদী-খাল ভরাট হচ্ছে যে আমাদের পুকুর ভরাট নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমাদের দাবি হলো, অতি দ্রুত সরকার পুকুরগুলো চিহ্নিত করে দিক। সাইনবোর্ড টাঙিয়ে এগুলোকে সংরক্ষিত ঘোষণা করুক। প্রয়োজনে রাজধানীর পুকুরগুলো সরকার অধিভুক্ত করুক। পুরান ঢাকায় অনেক এলাকা পুকুরশূন্য। সেখানে আগুন লাগলে পানি পাওয়া যায় না। সুতরাং বিষয়টিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

তবে এসব পুকুর সংরক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, আমরা পুকুর সংরক্ষণের জন্য কোনো ধরনের নির্দেশনা পাইনি। পেলে অবশ্যই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন