আলোকপাত

দেশে দারিদ্র্যের হার কত?

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার কত, সরকারিভাবে তা প্রকাশ করা হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশে দারিদ্র্যের যে হার উল্লেখ করেছেন তা পুরনো, অর্থাৎ ২০২০ ২০২১ সালের করোনাভাইরাসের প্রকোপকালের আগের। গত জুনে প্রকাশিতবাংলাদেশ আইপিসি ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি রিপোর্টটি ২০০৯-১৯ সময়কালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। এতে করোনা মহামারী-পরবর্তী সময়ের অর্থাৎ ২০২০ ২০২১ সাল শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। দারিদ্র্যের হার নির্ধারণে কাজ করা সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬ সালের পর সম্পর্কিত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সংস্থাটির সর্বশেষহাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬’- জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয়েছে ২৪ দশমিক শতাংশ। দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দারিদ্র্যের হারে যে ঊর্ধ্বগতি উঠে এসেছে তা গ্রহণে সরকার অনীহা প্রকাশ করেছে। তাই দেশে দারিদ্র্যের বর্তমান হার নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ২০১৮ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানান। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় দেশের দারিদ্র্যের হার নিয়ে অর্থমন্ত্রী কোনো বক্তব্য রাখেননি। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সেই সময় দেশে বিদ্যমান দারিদ্র্যের হারের উল্লেখ না করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১২. শতাংশে এবং অতিদারিদ্র্যের হার . শতাংশে নামিয়ে আনা।অর্থমন্ত্রীর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের একটানা এক যুগের শাসনামলের অর্জন নিয়ে একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক শতাংশ থেকে কমে ২০ দশমিক শতাংশে এবং অতিদারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক শতাংশে দাঁড়িয়েছে।আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় ব্যবহূত তথ্য পুরনো। তথ্য করোনাভাইরাসের প্রকোপকালের আগের। এর সত্যতা মেলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) থেকে। এতে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২০. শতাংশে নেমে এসেছে বলে হিসাব করা হয়। চরম দারিদ্র্য নিরসনেও একই চিত্র দেখা যায়। ২০১৬ অর্থবছরের চরম দারিদ্র্যের হার ১২. থেকে কমে ২০১৯ অর্থবছরে ১০. শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

হায়েস ২০১০ অনুযায়ী, দেশে ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে ২০১০ সালে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক শতাংশে। এতে প্রতি বছর দারিদ্র্যের হার হ্রাস পায় দশমিক শতাংশ হারে। হায়েস-২০১৬ মোতাবেক ২০১০ সাল-পরবর্তী বছরগুলোয় প্রতি বছর দারিদ্র্যের হার হ্রাস পায় দশমিক শতাংশ। দারিদ্র্যের হার হ্রাসের শ্লথগতি পরোক্ষভাবে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি ঘটায়। যেসব কারণে ২০১০ সালের পর দারিদ্র্য হ্রাসের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে এবং করোনাকালে দারিদ্র্যের হার বাড়ে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: এক. কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, কৃষিতে একসময়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে তলানিতে ঠেকেছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক ২০০৯-১০ অর্থবছরের দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়ায় দশমিক ১৭ শতাংশে, যা বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী হ্রাস পেয়ে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২১-২২) দশমিক ২০ শতাংশে দাঁড়াবে। এটি সম্ভবত গত কয়েক বছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হারের সর্বনিম্ন রেকর্ড। কৃষি দারিদ্র্যের হার হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ায় কৃষি সে ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না।

দুই. উন্নয়নেরট্রিকল ডাউনবা চুইয়ে পড়া তত্ত্ব তেমন কাজে আসেনি। গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধি ঘটলেও তা সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তেমন কাজে আসছে না। দেশে সম্পদ অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। দ্রুত ধনীদের শীর্ষ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। আয়বৈষম্য বৃদ্ধি দেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাসে সহায়ক হয়নি।

তিন. বেকারত্ব বৃদ্ধি। অর্থনীতির সংজ্ঞা মোতাবেক বেকারত্ব দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বিবিএসের ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে তরুণ-যুবাদের বয়সভিত্তিক বেকারত্বের হার থেকে দেখা যায়, ১৫-১৯, ২০-২৪ ২৫-২৯ বয়সসীমার তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ১২ দশমিক , ১২ দশমিক এবং দশমিক শতাংশ। গড় হার ১১ দশমিক শতাংশে। আর শিক্ষার ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্পন্নকারী শিক্ষিত তরুণ-যুবাদের বেকারত্বের হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ২২ দশমিক এবং ১৩ দশমিক শতাংশে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণ নেই এমন তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ২৯ দশমিক শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেশে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির বেকারত্বের যে হার উঠে আসে, বিগত দুই বছরে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে সে হারে বৃদ্ধি ঘটে। এই দুই বছরে কর্মসংস্থানে মূল ভূমিকা পালনকারী বেসরকারি খাতের অনেকে চাকরি হারান। ২০২০ সালের মাঝামাঝি মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের হিসেবে করোনার মধ্যে এখন পর্যন্ত লাখ ১০ হাজার পোশাক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সূত্রের বরাত দিয়ে ওই বছর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে কেবল পরিবহন খাতের ৫০ লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি খাতের অনেকে এখন পর্যন্ত হারানো চাকরি ফেরত পাননি বা পেলেও আগের মজুরি পাচ্ছেন না। সম্প্রতি একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর সময়ে চাকরিচ্যুত, বাধ্যতামূলক পদত্যাগ বা অবসরে পাঠানো ব্যাংকাররা চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে ১৫ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করেছেন। তারা বলেছেন, হঠাৎ চাকরি হারিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের চাকরি ফেরতের নির্দেশনা দিলেও অনেক ব্যাংক তা মানছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দ্রুত চাকরিতে বহালের দাবিতে বাধ্য হয়ে তারা মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন।

চার. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে একটি স্বীকৃত পন্থা। এটা ঠিক, কর্মসূচির আওতায় ক্রমান্বয়ে কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটছে এবং অর্থ বরাদ্দ বাড়ছে। সমস্যা হলো যে হারে সুফলভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে সে হারে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। সুফলভোগীদের মাথাপিছু বরাদ্দকৃত অর্থ তাদের জীবনধারণের ন্যূনতম উপকরণের চাহিদা মেটাতে সমর্থ না হওয়ায় তারাদারিদ্র্য চক্রথেকে বের হতে পারছেন না। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সহায়তায় তারা কোনো রকমে বেঁচে থাকছেন। জীবনমানের উন্নতি না হওয়ায় তাদের শ্রেণীগত পরিবর্তন হচ্ছে না। অর্থাৎ তারা অতিদরিদ্র/দরিদ্রই থেকে যাচ্ছেন এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাসে কোনো ভূমিকা রাখছেন না।

পাঁচ. বাজেটে সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ন গুরুত্ব না পাওয়া। হায়েস ২০১০ অনুযায়ী দারিদ্র্যের হারে শীর্ষে ছিল রংপুর অঞ্চল বা বিভাগ। হায়েস ২০১০- যখন জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য হার ছিল ৩১ দশমিক শতাংশ, তখন বিভাগ বা অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক শতাংশ। হায়েস ২০১৬- দেখা যায়, হায়েস ২০১০-পরবর্তী সময়ে রংপুর বিভাগ বা অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক শতাংশে। হায়েস ২০১০ এবং হায়েস ২০১৬ অনুযায়ী দেশের দারিদ্র্য তালিকার শীর্ষে থাকা অন্যান্য বিভাগ বা অঞ্চলগুলো হচ্ছে ময়মনসিংহ, খুলনা রাজশাহী। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০) পশ্চাত্পদ অঞ্চলের বৈষম্য নিরসনে যেসব কৌশল নির্ধারণ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: . পশ্চাত্পদ অঞ্চল তহবিল গঠন, . অবকাঠামো ব্যবধান হ্রাস, . পশ্চাত্পদ জেলাগুলোতে ম্যানুফ্যাকচারিং সুবিধাবলি বৃদ্ধি, . কৃষি গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ এবং . আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সুযোগ বৃদ্ধি। এসব কৌশল বাস্তবায়িত না হওয়ায় পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, যা দারিদ্র্য হ্রাসের গতিকে শ্লথ করে।

গত দুই বছরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং কর্মসংস্থানে মূল ভূমিকা পালনকারী বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি, বেতন/মজুরি হ্রাস এবং অন্যান্য কারণে মানুষের আয় কমেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পরিচালিতস্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১অনুযায়ী, করোনার সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। ২০১৬ সালের হায়েসে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২৪ দশমিক শতাংশে। ২০১৬ সালের পর নতুন করে হায়েস প্রণীত না হলেও সরকারি হিসাবমতে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক শতাংশে নেমে আসে। করোনাকালীন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার এখন পর্যন্ত জনগণকে জানায়নি দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার কত। এদিকে দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থা যেমন সিপিডি, পিপিআরসি, বিআইজিডির মতে, করোনা মহামারীর কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণার ফলাফলে প্রাপ্ত দারিদ্র্যের হারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও করোনাকালীন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার এখন পর্যন্ত জনগণকে জানায়নি দেশে দারিদ্রের হার কত। সরকারের উচিত হবে বর্তমানে দেশে দরিদ্রের সংখ্যা দারিদ্র্যের হার সম্পর্কিত তথ্য যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশের ব্যবস্থা করা। এতে দেশে দরিদ্রের সংখ্যা দারিদ্র্যের হার নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশার অবসান হতে পারে।

 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন