খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা থেকে দুই বছরেই মারাত্মক বিপর্যয়ে শ্রীলংকা

বণিক বার্তা ডেস্ক

ধানের ফলন কমে যাওয়ায় এ বছর জমিতে চীনাবাদামের চাষ করেছেন শ্রীলংকার এ কৃষক ছবি : জিপিজে

শ্রীলংকায় খাদ্য সংকট এখন মারাত্মক আকার নিয়েছে। কয়েক গুণ দাম দিয়েও প্রয়োজনীয় খাবার পাওয়া যাচ্ছে না দেশটির বাজারগুলোয়। শিশুর মুখে নিয়মিত প্রয়োজনীয় খাদ্য তুলে দেয়ার তাগিদে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন দেশটির অনেক বাবা-মা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, আড়াই কোটি নাগরিকের দেশটিতে এখন জরুরি মানবিক খাদ্যসহায়তার প্রয়োজন অন্তত ৫৭ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ২৩ লাখই শিশু। বর্তমানে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ থেকে নানা আকারে সহায়তা এলেও এখনো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি।

অথচ ২০২০ সালেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল শ্রীলংকা। প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিশ্ববাজার থেকে দেশটির চাল আমদানির প্রয়োজন তেমন একটা পড়েনি। বিনা প্রস্তুতিতে রাতারাতি কৃষি পদ্ধতি বদলাতে গিয়ে খাদ্য সংকটে পড়েছে দেশটি। রিজার্ভের দুরবস্থায় খাদ্য আমদানি করতে না পেরে সংকট আরো তীব্র হয়েছে। জ্বালানি সংকটে ব্যাহত উৎপাদনও। সব মিলিয়ে মাত্র দুই বছরেই খাদ্যে স্বয়ম্ভর থেকে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দেশ হয়ে উঠেছে শ্রীলংকা।

চলমান খাদ্য সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে দেশটির সরকারের কৃষি নীতিকে। গত বছরের এপ্রিলে অনেকটা আকস্মিকভাবেই রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকার। একই সঙ্গে দেশটির ২০ লাখ কৃষককে নির্দেশ দেয়া হয় অর্গানিক কৃষি ব্যবস্থা চালু করতে। স্থানীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রকেফেলার ফাউন্ডেশনের পরামর্শ।

গোতাবায়া রাজাপাকসের সিদ্ধান্তে পশ্চিমা উদারনৈতিক সংস্থাগুলো বেশ উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছিল। এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (ইএসজি) সূচকে শ্রীলংকার স্কোর বেড়ে দাঁড়ায় ১০০-এর মধ্যে ৯৮। কিন্তু স্কোর আদতে দেশটির জনগণের কোনো কাজেই লাগেনি। বরং দেশটির কৃষি খাতে নেমে আসে বড় ধরনের বিপর্যয়।

দেশটির চাল উৎপাদন কমে যায় ৫০ শতাংশেরও বেশি। রাতারাতি ৮০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে যায় খাদ্যশস্যটির দাম। খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশটি বিশ্ববাজার থেকে ৪৫ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের চাল আমদানি করতে বাধ্য হয়, যা দেশটির চাপে থাকা রিজার্ভ নিয়ে সরকারকে আরো বিপাকে ফেলে দেয়।

রিজার্ভ নিয়ে শ্রীলংকার বিপত্তি আরো বাড়িয়ে তোলে চায়ের উৎপাদন হ্রাস। দেশটির প্রধান অর্থকরী ফসল চা। আকস্মিকভাবে রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ায় দেশটিতে চা উৎপাদনও কমে যায়। চা রফতানিও কমে যায় মারাত্মক আকারে। বিপদ বুঝতে পেরে শ্রীলংকা সরকার একপর্যায়ে কৃষিতে রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।

গত বছরের নভেম্বরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় রাজাপাকসে সরকার। ততক্ষণে দেশটির খাদ্যশস্যের বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। চালের বাজারমূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠার পাশাপাশি শাকসবজির দাম বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি দেশটির প্রধান ভোক্তাশ্রেণী মধ্যবিত্তকে প্রায় রিক্ত করে তোলে। অর্থনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থানে থাকা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা আরো বেড়ে যায়।

অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্যে নেমে আসায় শ্রীলংকার জ্বালানি, সার খাদ্য আমদানি চালু রাখতে হিমশিম খেয়ে যায় দেশটির সরকার। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ ঋণের সুদ পরিশোধের চাপও দেশটির অর্থনীতিতে দিশেহারা ভাব তৈরি করে। একপর্যায়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয় দেশটি।

ক্ষুব্ধ, ত্যক্ত-বিরক্ত শ্রীলংকার জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলা চালিয়ে দখল করে নেয় তারা। পদত্যাগ করে সেনা পাহারায় পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। বিক্ষোভের মুখে কিছুদিন পর দেশ ছেড়ে পালান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেও। পতন হয় প্রতাপশালী রাজাপাকসে পরিবারের। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা হাতে নেন রনিল বিক্রমাসিংহে।

পশ্চিমা উদারনৈতিক সংস্থাগুলোর প্ররোচনায় রাতারাতি অর্গানিক চাষাবাদ প্রচলনের ভাবনায় শুধু রাজাপাকসে পরিবার নয়, আকৃষ্ট হয়েছেন শ্রীলংকার অন্যান্য রাজনীতিবিদও। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত এক নিবন্ধে একই চিন্তাভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। শুধু তা- নয়, ২০২৫ সালের মধ্যে ধরনের কর্মসূচির ভিত্তিতে শ্রীলংকাকে ধনী দেশের কাতারে তুলে নেয়ার প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। সে সময় নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা হারানোর বিষয়টি তার জন্য অনেকটাই শাপে বর হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, এর অন্যথায় দেশটির আজকের অবস্থার জন্য রাজাপাকসে পরিবারের পরিবর্তে তাকেই দায় নিতে হতো সবচেয়ে বেশি।

জাতিসংঘের বৈশ্বিক খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং খাদ্য কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাব অনুযায়ী, দেশটির ৬০ লাখের বেশি মানুষ এখন খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দিনে নানা মাত্রায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়েছে দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি খানার সদস্যরা। তারা যেটুকু খাচ্ছে, সেটুকুও মানসম্মত বা পুষ্টিসম্মত নয়। একই সঙ্গে দেশটির নারী শিশুদের মধ্যে এখন পুষ্টিহীনতাও বাড়ছে।

বর্তমানে শ্রীলংকার সরকার দেশটির কৃষকদের চাপ দিচ্ছে চাল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষকদের জন্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনিতেই দেশটিতে এখন সার কীটনাশকের অভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। উপরন্তু পরিস্থিতিকে আরো প্রতিকূল করে তুলেছে জ্বালানি সংকট।

মুহূর্তে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সার কীটনাশক জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে শ্রীলংকা সরকার। কিছুদিন আগেই রনিল বিক্রমাসিংহে এক টুইট বার্তায় বলেছিলেন, চলতি ইয়ালা (মে-আগস্ট) মৌসুমের জন্য প্রয়োজনীয় সার জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তবে আসন্ন মাহা মৌসুমে (সেপ্টেম্বর-মার্চ) উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সার জোগাড় করতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

বর্তমানে শ্রীলংকার বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনিশ্চয়তাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য, জ্বালানি সারের মূল্যবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে দেশটিতে চলমান সংকট এখন নানামুখী রূপ নিচ্ছে, যা থেকে শিগগিরই রেহাই পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন