ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ মুহূর্তে শিক্ষকের সংখ্যা ১ হাজার ৯৯২। যার মধ্যে নারী শিক্ষকের সংখ্যা ৬৬৮। অধ্যাপক ছাড়া সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষকদের বেশির ভাগেরই শিশুসন্তান রয়েছে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ সংখ্যা একাধিক। অথচ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সন্তানদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র তিনটি। সেগুলোতে সব মিলিয়ে ৮০টি শিশুর পরিচর্যার সক্ষমতা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। শিশুসন্তানকে বাড়িতে রেখে এসে বিশেষ করে মায়ের পক্ষে সবসময় কাজে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। অথচ শিক্ষকতার মতো পেশায় কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অনেক নারী কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থী আছেন, যাদের শিশুসন্তান রয়েছে। তাদের জন্যও আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রায়ই সন্তান লালন-পালনের জন্য নারী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ার কথা বা ড্রপআউটের কথা শোনা যায়।
দেশের সর্বোচ্চ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৩টি অনুষদ ও ১৩টি ইনস্টিটিউটের মধ্যে কেবল দুটি অনুষদ ও একটি ইনস্টিটিউটে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে।
জানা গিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান এবং নিজস্ব আয়ে পরিচালিত শিক্ষকদের সন্তানের জন্য প্রতিষ্ঠিত এ তিনটি সেন্টারের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সেন্টারে ১০টি শিশুর পরিচর্যা করার সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্থাপিত সেন্টারে ৪৫ এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে পরিচালিত সেন্টারে ২৫টি শিশুর দেখভাল করা যায়। সব মিলিয়ে তিনটি সেন্টারে ৮০টি শিশু পরিচর্যার সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কভিডের প্রকোপ শুরু হওয়ার কারণে এ মুহূর্তে সংকট কিছুটা কম থাকলেও অধিকাংশ সময় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি শিশু রাখতে হয়, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এর ফলে প্রতিটি শিশুর সঠিক পরিচর্যাও করা সম্ভব হয় না।
আবার এ সেন্টার তিনটি নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। সেন্টারগুলোর সেবার মান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক ও শিশুর মা বণিক বার্তাকে বলেন, সেন্টারগুলোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল এবং আলো-বাতাসপূর্ণ পরিবেশ নেই। এমনকি বাচ্চাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগও পাওয়া যায়। তাই শুধু সেন্টার প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না। এসব বিষয়ের প্রতিও নজর দিতে হবে। যে মায়েরা এ সেন্টারগুলোতে সন্তান পরিচর্যার জন্য রাখেন, তারা যেন নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন সে ব্যবস্থাও করতে হবে।
তিন শিশুসন্তানের জননী গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশরাফী মেহের নিগার বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবেই সন্তান ও পরিবারকে সময় দিতে হয়। শিশুসন্তানদের বাড়িতে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে মানসিক প্রশান্তি মেলে না। অনেক সময় সন্তানদের অসুস্থতার কারণে ক্লাস ক্যানসেল করতে হয়। পরে আবার সেগুলো মেকআপ করতে হয়।
একই রকম মানসিক অবস্থার মধ্যে আরো অনেক সহকর্মীই থাকেন জানিয়ে এ শিক্ষক বলেন, শিক্ষক-মায়েদের দুশ্চিন্তামুক্তভাবে শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। এতে সন্তানরাও যেমন মাকে তুলনামূলক বেশি সময় পাবে, তেমনি মায়েরাও নির্ভার মনে পাঠদানের কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন, যা তাদের শিক্ষার মান বাড়াবে।
পাশের দেশ ভারতে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে দেশটির সরকার। প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫০ জনের বেশি নারী কর্মী থাকলে সেখানে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। রয়েছেন শতাধিক নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীও। যাদের একটি অংশ বিবাহিত ও সন্তানের মা। শিক্ষকদের সন্তানদের জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। ফলে মা হয়ে যাওয়ার পর অনেক শিক্ষার্থীই লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে পারেন না। কেউ কেউ কয়েক বছর বাদ দিয়ে সন্তান কিছুটা বড় হলে আবার লেখাপড়া শুরু করেন। আবার শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়া শিক্ষার্থী মায়েদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
এমনই একজন নৃত্যকলা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের হুর-ই-জান্নাত। ২০২০ সালের মার্চে অনার্স তৃতীয় সেমিস্টার চলাকালে সন্তান জন্ম দেন তিনি। অনলাইনে তৃতীয় সেমিস্টার শেষ করে কভিড-১৯ মহামারী-পরবর্তী সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হলে সন্তান নিয়ে আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। টানা দুই সেমিস্টার পুনঃভর্তির পর বর্তমানে পরবর্তী ব্যাচের সঙ্গে ক্লাস করছেন।
শুধু হুর-ই-জান্নাত নয়; শতবর্ষী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে এ রকম মায়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। একক পরিবারে সন্তান পালনে সহযোগী না থাকায় যাদের অধিকাংশই পুরুষের পাশাপাশি কর্ম ও শিক্ষাজীবনে এগিয়ে যেতে পারছেন না। তাই দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানকে নিরাপদে রাখতে পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন তারা।
সন্তান রাখার ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রে এভাবে পিছিয়ে পড়তে হতো না জানিয়ে হুর-ই-জান্নাত বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমন রুমগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষার্থী সন্তান নিয়ে আসে। শিশুকে কারো জিম্মায় রেখে তারা ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেয়। এতে লেখাপড়ায় পূর্ণ মনোযোগ দেয়া যায় না। তাই শিক্ষার্থীদের সন্তানদের জন্যও ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর গত কয়েক মাসে অন্তত ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী পেয়েছেন যারা শিশুসন্তান রেখে ক্লাস করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। সে কারণে ক্লাস না করে কেবল পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি চেয়েছেন তারা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী শতকরা ৭০ ভাগ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে পরীক্ষা দেয়ার বিধান নেই। এজন্যই মূলত সন্তান জন্মের পর বাধ্য হয়ে অনেক ছাত্রীকে পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয়। সম্প্রতি বিভাগের অভ্যন্তরীণ এক সভায় তিনি একটি ডে কেয়ার সেন্টার চালুর প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন বলেও জানিয়েছেন।
আইন অনুযায়ী ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের দাবি জানিয়ে আরেকজন শিক্ষার্থী মা বণিক বার্তাকে বলেন, জন্মের পর একটি শিশুকে টানা প্রায় পাঁচ-ছয় বছর নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে রাখতে হয়। এ সময় মায়ের ভূমিকা বেশি থাকে। ফলে সন্তানকে দূরে রেখে পড়ালেখা-ক্লাস-পরীক্ষা কোনো কিছুতেই মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সন্তানদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা গেলে তাদের সমস্যার সমাধান হবে।
শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা তুলে ধরেন শিক্ষকদের সন্তানের জন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত ডে কেয়ার সেন্টারের ইনচার্জ বিলকিস জাহান। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে অনুষদের এক শিক্ষার্থী দম্পতি তাদের সন্তানকে ডে কেয়ারে রাখতে অনেক অনুরোধ করেছে। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ শিক্ষকদের সন্তানদের জন্যই এই ডে কেয়ারের সক্ষমতা অপ্রতুল।
‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন-২০২১’ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ ব্যবস্থাপনায় ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অনুষদগুলোকে আরো উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।