ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য ক্রয়ের সুবিধা চালু করেছে। এ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে সারা দেশে এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ড প্রদান করা হয়। টিসিবির এ কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি, অস্বচ্ছতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বলা হচ্ছে, ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পায়নি। নিজেদের করা গবেষণার প্রতিবেদন তুলে ধরে এ প্রকল্পে স্বচ্ছতা আনতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
গতকাল টিআইবি কার্যালয়ে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে এ গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। ‘টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
এতে বলা হয়, উপকারভোগীর তালিকায় করোনাকালে ২ হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত ৩৮ লাখ ৫০ হাজার উপকারভোগীর সবাইকে রেখে নতুন করে ৬১ লাখ ৫০ হাজার জনকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু আগে নগদ সহায়তাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পায়নি। এর মধ্যে ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ সম্ভাব্য উপকারভোগীকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বাদ দেয়া হয়।
জরিপে মোট অংশগ্রহণকারী নারীর ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং পুরুষদের মোট ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ উপকারভোগী অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ফ্যামিলি কার্ড পায়নি। ২ হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত উপকারভোগীর সব পরিবার এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে আট লাখ পরিবারকে কার্ড দেয়া হয়নি। অন্যদিকে নতুন করে প্রণীত তালিকায় বিভিন্ন সচ্ছল ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ওজনে কম দেয়া, ফ্যামিলি কার্ড থাকা সত্ত্বেও পণ্য কিনতে না পারা, দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পাওয়া, নির্ধারিত স্থানের পরিবর্তে অন্য স্থানে পণ্য বিক্রি করা, অতিরিক্ত অর্থ আদায় ইত্যাদি অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে।
পাশাপাশি কার্ড পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ সামর্থ্য না থাকায় একবারও পণ্য ক্রয় করতে পারেনি এবং ৩ দশমিক ৭ শতাংশ একবার পণ্য ক্রয় করতে সক্ষম হলেও দ্বিতীয় বার ক্রয় করার সামর্থ্য ছিল না।
দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, দ্বীপ ও চরাঞ্চল এবং দুর্যোগপূর্ণ হাওর এলাকায় পণ্য সরবরাহে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় টিসিবি। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকার প্রায় ৩ হাজার ৩০০টি পরিবারের কাছে টিসিবি সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য পৌঁছাতে পারেনি। অনেককেই সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে যাতায়াত বাবদ গড়ে ৩৩ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয় বলে উল্লেখ করে টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রায় এক কোটি পরিবারকে এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তের কারণে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে বাস্তবে এ প্রশংসনীয় উদ্যোগ প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করা টিআইবির ১০ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—জনপ্রতিনিধি কর্তৃক উপকারভোগীদের প্রাথমিক তালিকা তৈরির পর ওয়ার্ড সভার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তালিকা চূড়ান্ত করা; নারী, প্রতিবন্ধী, দলিত, আদিবাসী প্রভৃতি প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা; শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা এবং বিতরণের সময়, তারিখ ও স্থান ইত্যাদি তথ্য সব পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা; বিনামূল্যে তালিকাভুক্তি ও কার্ড বিতরণে অর্থ লেনদেন না করার বিষয়ে উপকারভোগীদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম (যেমন— এসএমএস প্রদান, ফ্যামিলি কার্ডে এ ধরনের তথ্য মুদ্রণ করে দেয়া ইত্যাদি) পরিচালনা করা; উপকারভোগীদের চাহিদা ও সামর্থ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে প্যাকেজে পণ্যের ধরন, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণ করা ইত্যাদি।