দেশের বাণিজ্যিক সিনেমার তালিকায় দুর্দান্ত সংযোজন

নাসরিন আক্তার

হাওয়ার জোয়ারে ভাসছে দেশ! ঢাকাই চলচ্চিত্রের রঙ-ঢঙ, জৌলুশ, নাচ, আইটেম গান আর নায়ক-নায়িকার সংগ্রামী প্রেমের উপাখ্যানের বাইরে গিয়ে খুবই সাধারণ খেটে খাওয়া কয়েকজন জেলের সাগরে মাছ ধরার কাহিনী নিয়ে বানানো সিনেমা হাওয়া। যেন সিনেমা নয়, বরং অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফিতে লেখা একটি কবিতা, নীল দরিয়ার বিশালতায় আলো-আঁধারির ছোঁয়ায় আঁকা কোনো পেইন্টিং! বাণিজ্যিক ধারার কোনো সিনেমা নিয়ে এতটা উল্লাস নিকট অতীতে দেখা যায়নি। সিনেমার অসাধারণ দৃশ্যায়ন, সাউন্ড ডিজাইন আর মেদহীন ঝরঝরে গল্প বলার ঢঙ পুরো সময়টা দর্শককে বিমোহিত করে রাখে।

রহস্যকে মূল চরিত্রে রেখে হাওয়ার গল্প এগিয়েছে বঙ্গোপসাগরে একটি নৌকায় থাকা কয়েকজন জেলে আর হঠাৎ করেই নৌকায় জেলেদের জালে উঠে আসা এক তরুণীকে নিয়ে। চরিত্রদের নেতৃত্বে রয়েছে ভীষণ রকমের নিষ্ঠুর আর কুটিল এক ব্যক্তি, যার নাম চান মাঝি। অন্য যেকোনো দিনের মতোই মাছ ধরতে জাল ফেলেছিল জেলেরা। কিন্তু সেদিন মাছের পরিবর্তে উঠে আসে এক মেয়ে। ঘাবড়ে যায় সবাই। প্রথমে মৃত ভাবলেও পরক্ষণেই দেখে মেয়েটি জীবিত। মাঝ সমুদ্রে কোথায় যাবে মেয়েটি, তাই নৌকায় তাদের সঙ্গে থাকতে দেয় জেলেরা। কিন্তু মেয়েটি আসার পর থেকেই ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। কেউ বুঝতে পারে না কে দায়ী তাদের অবস্থার জন্য, মাথার ওপর বিশাল শূন্য আকাশ, নিচে অথই দরিয়া নাকি রহস্যঘেরা সেই মেয়েটি? কাহিনী যতই এগোতে থাকে, ততই জটলা খুলতে থাকে।

দর্শককে সবচেয়ে যে বিষয়টা মগ্ন করে রাখে তা হলো এর অসাধারণ ভিজুয়াল আর ভিজুয়ালের সঙ্গে মিক্স করা নান্দনিক শব্দযোগ। সমুদ্রে নোঙর ফেলার দৃশ্যটি এমনই একটি দৃশ্য। নীল জল ভেদ করে বুদ্বুদ সাদা বাবল তুলে নোঙরটি সমুদ্রতলে যখন যাচ্ছিল ওই সময় বাবলের তালে শব্দের কম্বিনেশন ছিল দারুণ। সিনেমাটোগ্রাফি দেখে মনে হয়েছে পরিচালক ক্ল্যাসিক আর্টপিসগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এর ফ্রেমিং কম্পোজিশন করেছেন। পেশাদার অভিনয়, সাহসী ঝরঝরে সংলাপ, লিডিং ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল মুভমেন্ট সবকিছু যেন মুগ্ধ করে রাখে।

সব মিলিয়ে দারুণ একটি বিনোদনমূলক সিনেমা হাওয়া। কিন্তু যেভাবে অনেকে এটাকে বিকল্প ধারার সিনেমা বলছেন তা সিনেমা নয়। এটা পুরোটাই একটি বাণিজ্যিক ধারার, বিনোদননির্ভর সিনেমা। প্রথাগত ঢাকাই সিনেমার নাচ-গান, আর্কিটাইপ নায়ক-নায়িকার ধারা বাদ দিলেই একটা সিনেমা বিকল্প ধারার হয়ে যায় না। আর্জেন্টিনার দুই খ্যাতিমান চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ফার্নান্দো সোলানাস অক্টাভিও গেটিনো তাদের একটি নিবন্ধটুয়ার্ডস থার্ড সিনেমা তিন ধরনের সিনেমার কথা বলেছেনফার্স্ট সিনেমা, সেকেন্ড সিনেমা থার্ড সিনেমা। সরাসরি বিনোদন দেয়া এবং মুনাফা অর্জনের জন্য নির্মিত সিনেমা ফার্স্ট সিনেমা। সেকেন্ড ঘরানার সিনেমা নির্মাণের দিক থেকে অভিনব নিরীক্ষাধর্মী হয়। সেই সঙ্গে ক্যামেরা কেবল ব্যক্তির পিছু নিয়ে তার মনোজগৎ, চাওয়া-পাওয়া, যন্ত্রণাকে পর্দায় উঠিয়ে আনে। আর থার্ড সিনেমায় থাকে সমাজের শোষণ, নিপীড়ন, অন্যায় আর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার চিত্র। একই সঙ্গে থার্ড সিনেমা নির্মাণশৈলীর দিক থেকে প্রতিবাদী, অভিনব নিরীক্ষাধর্মী হয়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে হাওয়া সিনেমা প্রথম ঘরানারই সিনেমা। এখানে নির্মাণশৈলীর নতুনত্ব নেই, এমন কোনো আধেয়ও নেই যা কথা বলে শোষণ, নিপীড়ন, অন্যায় আর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সিনেমার শুরুতে একটি দৃশ্যে বৈষম্যের কথা এসেছিল যখন চান মাঝি রাতের অন্ধকারে মাছ বিক্রি করে দিচ্ছিল। সেই দৃশ্যে ইব্রাহীম চরিত্রটি প্রতিবাদ করে জানিয়ে দেয় তাদের সবার সমান কষ্টে ধরা মাছ বিক্রি করে কেউ একা টাকা নিতে পারবে না, টাকার ভাগ সবাইকে সমানভাবে দিতে হবে। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বক্তব্য মুহূর্তের মধ্যেই চাপা পড়ে যায় যখন বিনোদনের উপাদানগুলো আসতে থাকে।

গল্পের একমাত্র নারী চরিত্র গুলতি, যার প্রতিশোধের কাহিনী নিয়ে সিনেমা, অথচ সেই চরিত্রটি ছিল সবচেয়ে প্রাণহীন। পুরো সিনেমায় গুলতির চলাফেরা দেখানো হয়েছে নৌকায় থাকা চরিত্রগুলোর দৃষ্টি থেকে। সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি তাকে। বরং গুলতির উপস্থিতি ছিল অন্য চরিত্রগুলোর সক্রিয় ভূমিকার অনুপ্রেরণা হিসেবে। গুলতির চলাফেরা, গোসলের দৃশ্য, সাগরে সাঁতার কাটা, বাতাসে কাপড় শুকানোর দৃশ্যগুলো এমনভাবে ধারণ করা যা পুরুষ দৃষ্টির তুষ্টি জোগায়। নারী দর্শকরাও গুলতিকে সেকেন্ডারি পার্সপেক্টিভ পুরুষ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে বাধ্য হয়।

এগুলো বাদ দিলে সিনেমাটি বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত একটি সংযোজন। আশার বিষয় এই যে, বাংলাদেশে বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর কনটেন্টে বৈচিত্র্য আসছে, হলে গিয়ে দেখার মতো সিনেমা তৈরি হচ্ছে, নতুন নতুন তরুণ পরিচালক এগিয়ে আসছেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। এভাবেই হয়তো পরিচালকদের হাতেই একদিন চিন্তাশীল সিনেমা নির্মিত হবে, যেখানে তারা দর্শককে মুখোমুখি করিয়ে দেবেন সমসাময়িক সমাজের আলো-বাতাসের সঙ্গে এবং তাদের ভাবতে বাধ্য করবেন।

 

নাসরিন আক্তার : সহকারী অধ্যাপক, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন