দরিদ্রদের চাপ কমাতে বিশেষ প্রণোদনার পরিকল্পনা

দ্রুত চূড়ান্তপূর্বক স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হোক

সম্প্রতি ভোক্তা পর্যায়ে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। এর প্রভাবে চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আবার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সার্বিক অভিঘাত আরো নয় মাস থাকবে বলে অর্থ বিভাগের বিবৃতিতে উঠে এসেছে। অবস্থায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কিছুটা স্বস্তি দিতে বিশেষ প্রণোদনার কথা ভাবা হচ্ছে। বিরাজমান বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি নিশ্চয়ই এক সময়োপযোগী পরিকল্পনা। দ্রুত চূড়ান্তপূর্বক স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভালো উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করাটাই জরুরি।

করোনা মহামারী সবে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি সচল হওয়ায় মহামারীর অভিঘাত থেকেও কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল মানুষ। তার মধ্যেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্ববাজারে এর  প্রভাব পড়ে বহুমুখী। আলোচ্য যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, নির্মাণ উপকরণসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। দ্রুত বদলে যায় দেশের অভ্যন্তরীণ চিত্রও। গত জুনে মূল্যস্ফীতি সাড়ে শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, নয় বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। জীবনযাত্রায় এর উত্তাপ লক্ষ করা যাচ্ছিল। এর মধ্যেই আগস্ট থেকে ডিলার কৃষক পর্যায়ে সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। তার রেশ কাটতে না কাটতেই সাম্প্রতিক সময়ে নেয়া হয় অতিমাত্রায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ। মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন কৃষি খাতে এরই মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পরিবহন সেবা কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, যা আরেক দফা মূল্যস্ফীতি উসকে দিয়েছে। নিম্ন মধ্যম শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতিতে তারা কোনোভাবে পেরে উঠছে না। সামনে আরো দুঃসময় অপেক্ষা করছে। সব মিলিয়ে আর্থিক চাপে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সার্বিকভাবে তাদের চাপ প্রশমনই এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ।

আমরা দেখছি, এরই মধ্যে সরকার দরিদ্রদের কষ্ট লাঘবে ওএমএস কার্যক্রমের আওতা বাড়িয়েছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য বিক্রিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। একই সঙ্গে কিছু সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমও চালু রয়েছে। এর আওতায় বয়োবৃদ্ধ, বিধবা, এতিম, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী, নারীপ্রধান পরিবার এবং অন্যদের নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় তা অনেকটা অপর্যাপ্ত। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতিমূলক চাপ অনেক বেড়ে গেলেও একই মাত্রার ভোগের জন্য অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হয়নি। ফলে তারা বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। সামনে মূল্যস্ফীতির আঁচটা আরো বেশি অনুভূত হবে। কাজেই আর্থিকভাবে নাজুক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সরকার যে ভাবনা-চিন্তা করছে তা বাস্তবসম্মত। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নই কাম্য।

অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সার্বিক অর্থনীতিতে পড়া প্রভাব মোকাবেলায় কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া যায় সেসব বিষয়ে তারা কাজ করছেন। এর মধ্যে দারিদ্র্য হার ৩০ শতাংশের ওপরে থাকা অঞ্চল উপজেলাগুলোর জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নেয়ার কথা ভাবছে সরকার। অতিদরিদ্রপ্রবণ এসব অঞ্চলে কর্মসৃজন করবে এমন লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হলে কর্মহীন নিম্ন আয়ের পরিবারকে নগদ সহায়তা প্রদানেরও চিন্তা-ভাবনা চলছে। এগুলো এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়ে গেছে। কোনোটাই চূড়ান্ত করা হয়নি। মানুষের কষ্ট যেভাবে বেড়ে চলছে, তাতে সম্পর্কিত একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসাটা দ্রুত জরুরি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয়তা আশা করি।

তবে মূল চ্যালেঞ্জটা সুফলভোগী নির্বাচন এবং সঠিক মানুষের হাতে প্রণোদনা পৌঁছে দেয়া। দুঃখজনকভাবে সুফলভোগীর তালিকা তৈরি এখনো আমলা দুর্নীতিগ্রস্ত  জনপ্রতিনিধিদের ঘেরাটোপে বন্দি। তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া নতুনভাবে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কমিউনিটির কার্যকর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। প্রক্রিয়াগত দুর্বলতাগুলো দূর না করলে অর্থের নয়ছয় প্রতিরোধ করা কঠিন। কাজেই সুফলভোগী নির্বাচন থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যায়ে আগে যেসব ত্রুটি বা দুর্বলতা ছিল, তা দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনার সময় দেয়া প্রণোদনার সুফলভোগীর তালিকা তৈরিতে অনেকটি ত্রুটি অনিয়ম ছিল। তালিকা তৈরি করা হয়েছিল জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ইউএনও, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারদের সমন্বয়ে। ওই তালিকায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সচ্ছল পরিবারকে অন্তর্ভুক্তি, অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে সুবিধা নেয়া পরিবারকে সংযোজন, সরকারের পেনশনভোগী পরিবারকে যুক্ত এবং জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজনের নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ মেলে। এমনকি অস্তিত্বহীন নামের বিপরীতে কিছু জায়গায় অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মতো অনিয়মও উঠে এসেছিল সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। এসব কারণে প্রকৃত সুফলভোগীদের অনেকেই নগদ সহায়তা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এখন যে প্রণোদনার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে, তাতে এটা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

নানা দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশে প্রায়ই জরুরি আপত্কালীন সহায়তা প্রদান করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকারগুলো অনেক সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। তাদের কাছে একটা ব্যাপকতর তালিকা আছে। আবার অনেক বেসরকারি সংস্থাও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে। তাদের কাছেও নাজুক জনগোষ্ঠীর একটি বিস্তৃত তালিকা রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে হয়তো সেখান থেকে অনেকে বাদ পড়েছে, আবার অনেকে হয়তো তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সরকারি বেসরকারি সংস্থার তালিকা পর্যালোচনা করে প্রথমে একটা হালনাগাদ নতুন তালিকা তৈরি করতে হবে। শুধু গ্রাম বা প্রত্যন্ত এলাকা নয়, শহরাঞ্চলেও প্রণোদনা দেয়া দরকার। শহরে নগর দারিদ্র্য একটা বড় প্রপঞ্চ। তাদের মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপটা আরো বেশি পড়ে। শহরে দরিদ্র শ্রেণীর বাস মূলত বস্তি এলাকায়। উদ্দীষ্ট এলাকায় একটা প্রাথমিক জরিপ সহজেই সুফলভোগী চিহ্নিত করা যায়। প্রয়োজনে নগর স্থানীয় সরকারগুলোর সহযোগিতা নেয়া চাই। আজকাল সব দেশেই সুফলভোগীর তালিকা প্রস্তুত এবং স্বচ্ছভাবে বিতরণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। করোনার সময়ে ভারতসহ কিছু দেশে এসব ক্ষেত্রে নতুন অনেক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে এখানে একটি দুর্নীতিমুক্ত, নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব। এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

দরিদ্রদের জন্য নতুন যে প্রণোদনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে নিঃসন্দেহে তা সময়োচিত। এখন সহায়তা যেন প্রকৃত সুফলভোগীরা পায়, তা নিশ্চিতের দায়িত্ব প্রশাসনের। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও জীবনযাত্রা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই প্রণোদনার বিষয়টি শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আরো বিস্তৃত করা যায় কিনা, তাও পর্যালোচনার দাবি রাখে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন