আলোকপাত

আইএমএফের ঋণ ও শর্ত অর্থনীতির শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কতটা কার্যকর

ড. আর এম দেবনাথ

আজ বাইশে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ভেবেছিলাম আজ কবিগুরুর কিছু গান শুনব, হয়তো বরাবরের মতোই। না, বিধিবাম! সকাল বেলার কাগজ হাতে পেয়েই দেখলাম দৈনিক বণিক বার্তার খবরের শিরোনাম দেশে ডিজেল-কেরোসিনে ৪২ দশমিক শতাংশ, অকটেন-পেট্রলে ৫০ শতাংশের বেশি মূল্যবৃদ্ধি। খবরে বড়ই আশাহত হলাম, দুঃসংবাদের বার্তা পেলাম। এত সকাল সকাল দুঃসংবাদ পাব তা ভাবতে পারিনি। ভেবেছিলাম সরকার আগে বাঁচানো টাকা দিয়ে সামাল দেবে। আগে, মানে অনেকদিন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল কমকিন্তু জনগণ কিনেছে বেশি দাম দিয়ে। অনেক টাকা সেখানে সাশ্রয় হয়। ওই টাকার কী হলো তা জানার আগেই সরকার খবর দিল দিন-কাল ভালো নয়। লোডশেডিং করে, বিদ্যুৎ বাঁচিয়ে, সরকারি বিদ্যুৎ বাঁচিয়েও হচ্ছে না। অগত্যা মূল্যবৃদ্ধি। যেই সেই মূল্যবৃদ্ধি নয়, রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি। ডিজেল লিটারে ৩৪ টাকা, কেরোসিন লিটারে ৩৪ টাকা, পেট্রল লিটারে ৪৪ টাকা এবং অকটেনে লিটারপ্রতি ৪৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এত বড় দুঃসংবাদ অস্বস্তির খবরের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভেবেছিলাম লিটারে হয়তো ১০-২০ টাকা বাড়তে পারে। না, তা হলো না। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাধারণ ক্রেতাদেরও মুক্তি দিলেন না। কেরোসিন ডিজেলের দামও বাড়ালেন। একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থা। যদিও বন্ধুর কথা বিশ্বাস করলে তা হওয়ার কথা ছিল না। সে কয়েকদিন আগে আমাকে বলেছিল, আসিতেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কথা বলে সে সাবধান করেছিল। আমি বললাম, ছোটবেলায় শুনতাম, আসিতেছে কমলা সার্কাস, আসিতেছে জেমিনি সার্কাস। এতে আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু বন্ধু বলল, আসিতেছে আইএমএফ ওই জিনিস নয়। তারা সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। যেখানে যায় দুস্থদের সাহায্যের নামে অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে আসে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় তা- বলে। কথা জেনেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী আইএমএফের কথা এত দিন শোনেননি। তিনি শত চাপের মধ্যেও সারের ওপর থেকে ভর্তুকি, কৃষির ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করেননি। বলাই বাহুল্য, এর সুফল আমরা পেয়েছি। চাল উৎপাদন, শাকসবজি উৎপাদন, নতুন নতুন ফলমূল উৎপাদনে আমরা অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছি। এখন এমন কী হলো যে, রাতারাতি সার, জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হলো? এর কারণ আন্তর্জাতিক সংকট; প্রথমে উহান থেকে আগত কভিড, এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজার উত্তাল। সর্বত্র মূল্যস্ফীতি। তেলের মূল্য, চালের মূল্য, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি সরবরাহ ঘাটতি। চাহিদা আছে, কিন্তু সরবরাহ নেই। সংকটে আমরাও পড়েছি। অথচ কিছুদিন আগেও আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা বিভিন্ন দেশকে ডলার সাহায্য দেব। সে অনুযায়ী শ্রীলংকাকেও আমরা ডলার ঋণ দিয়েছি। তিনি এও বলেছিলেন, আমরা আইএমএফের দ্বারস্থ হব না। তারা কী কী শর্ত দেয় তা দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেব। বোঝা যাচ্ছিল তিনি আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে চান। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে চান না। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করছে আইএমএফের দিকে যেতে। আমদানি মারাত্মক বেশি (আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং) অথচ রফতানির পরিমাণ সেভাবে বাড়েনি। আগে রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে আমদানি-রফতানির ঘাটতি মেটানো যেত। কিন্তু সেই রেমিট্যান্সেও টান পড়েছে। বহুদিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি, ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি। ডলারের দাম খোলাবাজারে ১১৫ টাকায় উঠেছে। ডলার পাওয়া যায় না। ঋণপত্র খোলা নিরুৎসাহিত। বড় বড় ঋণপত্র এখন পরীক্ষাধীন। বিদেশী ব্যাংকগুলো আমাদের ঋণপত্র (এলসি) গ্রহণ করতে চায় না। তারা অ্যাড কনফারমেশন চায় অর্থাৎ বিদেশী ব্যাংকের গ্যারান্টি চায়। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই হ্রাসমান। সরকার বলছে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ সরকারের হিসাব মানছে না। তাদের হিসাবে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের মতো। এই হচ্ছে সংক্ষেপে বাংলাদেশের সংকট। ধরনের সংকটে, আমদানি-রফতানির মধ্যে ঘাটতি জাতীয় সংকটে আন্তর্জাতিক উদ্ধারকর্তা হচ্ছে কেলেঙ্কারি জর্জরিত (এর প্রধানদের বিরুদ্ধে অতীতে অনেক অভিযোগ শোনা গেছে) আইএমএফ এই আইএমএফ আসিতেছে। তাদের বরণ করার প্রস্তুতিই সরকার নিচ্ছে বলে মনে হয় না কী? আগস্টের একদম শুরুতেই বাড়ানো হয়েছে সারের দাম। ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে বাড়ানো হয় টাকা। আর এবার বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বলাই বাহুল্য, অর্থনীতিতে এর বহুমুখী প্রভাব পড়বে। গ্যাস, বিদ্যুতের দামেও এর আছর পড়বে। আমাদের দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ওত পেতে বসে আছেন। রোদে, বৃষ্টিতে, বাজেটে, ঈদে, পার্বণে তারা যেমন ছাড় দেয় না; এবারো তারা মোচে তা দিচ্ছেন। ফলাফল যা হওয়ার তা- হবে। ফলাফল যা- হোক না, বোঝা যাচ্ছে সরকার আর পথ পাচ্ছিল না। অর্থমন্ত্রী তার কথা রাখতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীকেও কেউ বিকল্প দেখাতে পারছেন না। বিকল্প হচ্ছে রাজস্ব বাড়ানো যা একটি কঠিন কাজে পরিণত করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা ভ্যাট দিতে চান না। পদে পদে চান কর রেয়াত, সুদ ভর্তুকি, কর অব্যাহতি, আয়কর থেকে অব্যাহিত। তারা দেশের উন্নয়ন করছেন। কাজেই তারা থাকবেন করের ঊর্ধ্বে। কিন্তু এবার কী হবে? আইএমএফ তো আসিতেছে। তাদের বরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এতে কী হবে? যা হওয়ার তাই হবে। কারণ তারা বড়ই নিষ্ঠুর। বাজার অর্থনীতির কথা বলে তারা শর্ত দেবে অনেক। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখলাম তারা কয়েকটি শর্তের ঝোলা নিয়ে আসছে। এগুলো হচ্ছে: বিদ্যুৎ জ্বালানিসহ সামষ্টিক বাজেট ঘাটতি কমানো, ব্যাংক-আর্থিক খাতের সংস্কার খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ না করা প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতি অতিমূল্যায়ন রোধ। হয়তো তালিকায় আরো অনেক কিছু আছে। শত হোক তারা আসছে মহাজন হিসেবে, আমরা ঋণগ্রহীতা। আইএমএফ, জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে সম্ভবত আমরা চাইব সাড়ে বিলিয়ন ডলার। কত দিয়ে যাবে, কী কী শর্ত দেবে তা আমাদের রুপালি পর্দায় দেখতে হবে। অপেক্ষা করতেই হবে।

অনেক শর্ত। সব তো এক নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমি আজ ব্যাংক আর্থিক খাত সংস্কারের সামান্য একটু অংশের ওপর কিছু আলোচনা করতে চাই। বিষয়টি হচ্ছে লিমিটেড শব্দটি। আমরা জানি, সব সরকারি ব্যাংকের নামের শেষে আগে কোনো লেজ ছিল না। আগে ছিল সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ইত্যাদি নামীয় ব্যাংক। আইএমএফের পরামর্শে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে জাতীয়করণের আওতামুক্ত করা হলো। সবগুলোকে করা হয় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। অর্থাৎ এদের জন্ম/পুনর্জন্ম হলো কোম্পানি অ্যাক্ট ১৯৯৭-এর অধীনে। লেজ হিসেবে যোগ হয় লিমিটেড। সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, জনতা ব্যাংক লিমিটেড। কেন? আইএমএফ বলেছে ব্যাংকে ব্যাংকে সুশাসন কায়েম করতে। কবে? আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে। এর জন্য বিপুল বরাদ্দ দেয়া হলো। ব্যাংকে ব্যাংকে বসানো হয় বড় বড় বেতনের আইএমএফ নিয়োজিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সুযোগ-সুবিধা প্রচুর। বিভাগে বিভাগে বসানো হয় ডজন ডজন পরামর্শদাতা (কনসালট্যান্ট) তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিচার-বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠিত করবে। সুশাসনের ব্যবস্থা করবে। নিয়ম-কানুন, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, অডিটিং, ঋণ ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণে আনতে হবে বিশাল বিশাল পরিবর্তন। ব্যাংকের শেয়ার লাভজনকভাবে বিক্রি হবে শেয়ারবাজারে। ব্যাংকের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বিশেষ করে ঋণ ব্যবস্থাাপনা। একইভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও ডজন ডজন প্রকল্প নেয়া হয় ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা শক্ত করার জন্য। কোটি কোটি টাকা স্ট্রেংদেনিংয়ের জন্য। প্রশিক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো না কোনো কর্মকর্তা থাকতেন সব সময়ই বিমানে। সাবেক অর্থমন্ত্রী (প্রয়াত) মুহিত সাহেব একবার বাংলাদেশ ব্যাংককে ধমক দিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন এসব কী হচ্ছে? কেন ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিদেশে যাচ্ছেন গবেষণা/প্রশিক্ষণের জন্য। লা জবাব। এসবের পর কত বছর কেটেছে। কত নিয়ম-কানুন চালু হয়েছে। ফর্মুলা চালু হয়েছে। তারা যা বলেছে তা- করা হয়েছে। নিজের দেশের বুদ্ধি-বিবেচনার বাইরে গিয়ে কত কী করা হলো? কিন্তু ফল? ফল শূন্য বলব না, বলব নেতিবাচক।

ব্যাংকগুলো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। এগুলো চলার কথা ছিল দেশের অন্যান্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মতো। স্বাধীনভাবে চলার কথা ছিল। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জিএম, ডিজিএমসবই নিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল বোর্ড কর্তৃক। বোর্ড করবে কে? যেহেতু শতভাগ মালিক সরকার, তাই বোর্ড করে দেবে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়। তারপর? তারপর বাকিটা বোর্ডে। পদায়ন, পদোন্নতি, বিচার-আচার করার কথা বোর্ডের। অথচ আজ দেখা যাচ্ছে, কীসের বোর্ড, ব্যাংক চালায় মন্ত্রণালয়, চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইন মোতাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক ক্ষমতা। ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকের ক্ষমতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যার জন্য আলাদা বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর নাম আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ফার্স্ট ক্লাস বিষয়! সব ক্ষমতা এখন তাদের হাতে। শুধু তা- নয় ব্যাংকের যে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রয়েছে তার বোর্ডও করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই বিভাগ। ভালো ধরনের স্বায়ত্তশাসন-সুশাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমডি নিয়োগ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়, তার ভালো-মন্দের দায় নিতে হবে তাদের। না, নিয়োগ তাদের, দায় বোর্ডের। এমডিরা যেহেতু মন্ত্রণালয়ের, তাই তারা বোর্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। তারা অফিস করে মন্ত্রণালয়ে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোথাও কোথাও বোর্ডের চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয় না। আবার কোথাও কোথাও সকালে চেয়ারম্যান, বিকালে সার্ভিস প্রোভাইডার হয়েছে সুশাসনের ব্যবস্থা? তাই নয় কি? দেখা যাক এবার আইএমএফ কী বলে, আর কী বলে সরকার।

 

. আর এম দেবনাথ: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন