জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধির প্রভাব ভোগ্যপণ্যের বাজারে

সুযোগ হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক

জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের সব খাতে। বেড়ে গিয়েছে প্রায় সব পণ্যের দাম। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে শুধু পরিবহন খরচই নয়, উৎপাদন ব্যয়ও আরেক দফা বেড়েছে। দেশে বেশ কিছুদিন ধরেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণহীন, সক্রিয় রয়েছে বাজার সিন্ডিকেটও। এসব সংকটে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ডলার বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা। অর্থনীতিতে একসঙ্গে বেশকিছু সমস্যা সক্রিয় রয়েছে, যা প্রতিটি সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করছে। জ্বালানি তেল একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। জ্বালানি তেলের দাম সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কাজ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। সরকারের উচিত, জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য দ্রুত যৌক্তিক করা এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা। সর্বোপরি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে কেউ যেন পণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়াতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে সরকারকে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।

কভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বহু মানুষেরই হয় চাকরি নেই অথবা কর্মক্ষেত্রে কাজের সংকোচন ঘটেছে। ফলে উপার্জন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে সংসার চালানোই সমস্যা। মানুষগুলোর কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে এবং মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। নাগরিক সমাজ যাতে মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত না হয়ে পড়ে, সেটা দেখাও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য। কভিডের সময় পৃথিবীজুড়ে যে জোগান ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছিল, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার বদলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাকে আরো বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ফলে বাজারে সার্বিকভাবে জোগানে টান পড়ছে। এসব বিষয় দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির কারণ যদিওবা বোঝা যায়, তবে আলাদা করে খাদ্যপণ্যের দাম কেন বাড়ল, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। দাম কমিয়ে আনার জন্য তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করা উচিত। পাশাপাশি দামের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেএমন লোকজনকে সরকারি সহায়তা হিসেবে নিজস্ব মজুদ থেকে কিছু নিত্যপণ্য সরবরাহ করা বা ভর্তুকি দেয়া উচিত এবং খুচরা বাজারে সরকারের মূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে এসব পণ্য বিক্রির ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে যে ভয়াবহ পরিণতি হয়, তার কথা চিন্তা করে বহু দেশই জ্বালানি তেল আমদানির ওপর শুল্ককর প্রত্যাহার করে দাম কম রাখার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশেও এক্ষেত্রে শুল্ককর প্রত্যাহার করা হলে মানুষ এর সুফল পেত। অথচ সরকার সেটাও করেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে মধ্যবিত্তও পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দরিদ্র মানুষকে কতটা কষ্ট করতে হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষি খাতেও এর সরাসরি প্রভাব পড়বে, কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে। এছাড়া বৃদ্ধি পাবে সব ধরনের পরিবহন ব্যয়। শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে বাড়বে পণ্যের দাম। এভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সার্বিক অর্থনীতিতে এর বহুমুখী প্রভাব পড়বে। বস্তুত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এমন সিদ্ধান্ত জনগণের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করবে, অর্থনীতিকে করবে বিপর্যস্ত। দেশে বিভিন্ন প্রকল্পে যেসব দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেসব ঠেকাতে পারলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা যেত। সরকারের প্রতিটি প্রকল্পে যথাযথ স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব। সে অর্থ দিয়ে জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দেয়া কঠিন নয়।

কথা মানতেই হবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকেই অস্থির করে তুলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সিদ্ধান্তগুলোয় স্বচ্ছতা জবাবদিহি কম। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানোর যুক্তিটাও গোলমেলে। করোনা মহামারীর সময় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য যখন অনেক কম ছিল, তখন দেশের বাজারে দাম কমানো হয়নি। সে সময় অনেক লাভ করেছে বিপিসি। সিরিয়া যুদ্ধের সময় যখন জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে ঠেকেছিল, তখনো বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি দামে তেল কিনেছে। গত সাত বছরে বিপিসি ৪৩ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সেটা জনগণেরই টাকা। বিপিসির সেই লাভের টাকাটা যদি ভর্তুকিতে ব্যবহার করা হতো, তাহলে জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি দেয়া যেত। এছাড়া বিপিসি এত বছরেও কেন শোধনাগার বাড়াতে পারল না, এরও জবাব নেই। বিপিসির অদক্ষতাকে কেন জনগণের পকেট থেকে অর্থায়ন করতে হবে সেটাও জানা যাচ্ছে না। সরকার যে শুল্ক কর নেয় বিপিসি থেকে সেটা কমালেও হতো। 

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থা যথাযথ তদারকির আওতায় এনে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের কারসাজি কিংবা কারো অসদাচরণের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্নভাবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন পেট্রোপণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে; ন্যায্যমূল্যের দোকানের মাধ্যমে জনসাধারণকে খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি; প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে; দেশজুড়ে সেচ এবং পণ্য মজুদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে; বিভিন্ন অত্যাবশ্যক পণ্য এবং ওষুধের উপরে ভর্তুকি দিয়ে; মজুদদারি একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে; এবং মাঝে মধ্যে বিদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির মতো নানা পদক্ষেপ নিয়ে।

সন্দেহ নেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী মধ্যবিত্তের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র অনেক অর্থনৈতিক খাতের উদ্যোক্তারা অত্যধিক চাপে পড়বে। তাদের জন্য সরকার কী করবে পরিষ্কার করে বলা দরকার। কৃষি খাতে পর পর দুটি বড় সিদ্ধান্ত এসেছে। সারের মূল্যবৃদ্ধির পর ডিজেলের দামও একধাপে অনেকটা বাড়ল। ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে সেচে একটা বড় খরচ বেড়ে যাবে। অনেকে কৃষিকাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। তাই অন্তত ডিজেলের দাম পুনর্মূল্যায়ন করা যায় কিনা ভাবা দরকার। কৃষক ডিজেলে ভর্তুকি না পেলে কৃষি খাতে বড় ধাক্কা আসবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূলবৃদ্ধির কারণে দেশে দাম বাড়ানোর চাপ ছিল সত্য। তাই বলে একবারে এত বাড়ানো যৌক্তিক ছিল না। সরকারের উচিত ছিল নমনীয়ভাবে দাম বাড়ানো, ধারাবাহিকভাবে দাম বাড়ানো। এটা করলে জনজীবনে একবারে এত চাপ বাড়ে না। তাছাড়া বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানির দাম কমে তখনো এর সুবিধা দেশের মানুষকে দেয়া দরকার এবং দেশের মানুষের সেটি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেটি অনেক ক্ষেত্রেই করা হয় না। আমাদের প্রত্যাশা, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার জনমুখী সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে কেউ যেন মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারে।

ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্তের ফলে অপেক্ষাকৃত ধনী ক্রয়ক্ষমতা যাদের বেশি, তারা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দরিদ্র ক্রয়ক্ষমতা যাদের কম, তারা অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। থেকে উত্তরণে সামষ্টিক অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, প্রয়োজন প্রণোদনা ভর্তুকির কাঠামোগত পুনর্বিবেচনা। উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে আয়-ভোগবৈষম্য কমানো যাচ্ছে না। সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিতের অঙ্গীকার করেছিল। তাদের প্রণীত রূপকল্প-২০৪১, যার দর্শনগত ভিত্তি হচ্ছে বাংলাদেশ হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র। সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ধরনের নীতি সংগতিপূর্ণ নয়। সামষ্টিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে উন্নয়ন দর্শনের বৈপরীত্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিতের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। একটা সুযোগ অবশ্য আছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া পুরো বিষয় নিয়ে পুনর্ভাবনা। অর্থনীতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তার বহুমুখী অভিঘাতের তাত্পর্য বিবেচনায় নিয়ে। একটি প্রতিষ্ঠান, একটি মূল্য সমন্বয়, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন