৫০ বছরে ‘ওরা ১১ জন’

ফিচার প্রতিবেদক

‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার দৃশ্য

ওরা ১১ জন। নামটি শুনলেই চোখের সামনে কতগুলো তরুণ মুখ ভেসে ওঠে। চোখে স্বপ্ন শঙ্কা, কিন্তু তার পাশেই দৃঢ় প্রত্যয়। কাঁধে রাইফেল নিয়ে দেশ স্বাধীন করতে যাচ্ছে ওরা। চাষী নজরুল ইসলামের সিনেমাটি আমাদের সেই স্বপ্ন প্রত্যয় দেখিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট। সিনেমাটি মুক্তির ৫০ বছর পূর্ণ হলো আজ। সিনেমাটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বহু কিংবদন্তির নাম। যেমন ওরা ১১ জন প্রযোজনা করেছিলেন মাসুদ পারভেজ। অভিনেতা হিসেবে সোহেল রানা নামে তিনি সমধিক পরিচিত।

মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ওরা ১১ জন নির্মাণ করা ছিল সে সময়ের জন্য বিশাল একটি অর্জন। সিনেমায় মুক্তিযোদ্ধারাই অভিনয় করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল নান্টু। এছাড়া রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলতাফ, মুরাদ, নান্টু, বেবী, আবু, খলিলউল্লাহ খানসহ আরো অনেকে সিনেমাটিতে অভিনয় করে সে সময়ে আলোচনায় আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ আর দেশের মানুষের আবেগের যোগসূত্র পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিল ওরা ১১ জন। তাই ৫০ বছর পূর্ণ করে আজও সিনেমাটি আমাদের আবেগাপ্লুত করে।

ওরা ১১ জন সিনেমায় ১১ জন মুক্তিকামী যুবকের গল্প উঠে এসেছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করেছে। সাদা-কালো সিনেমায় নিপুণভাবে ক্যামেরা বন্দি করা হয়েছে এর প্রতিটি দৃশ্য। সিনেমার গল্প সাবলীলভাবে এগিয়েছে, যাতে দর্শক সিনেমাটি দেখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শোচনীয় অবস্থা বুঝতে পারেন। সার বেঁধে সৈন্যদের ছুটে চলা, হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার দৃশ্য দক্ষভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এতে। এমনকি যুদ্ধের দৃশ্যগুলো আরো বাস্তবভাবে দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সত্যিকারের গোলাবারুদ। সিনেমায় প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মার্চের ভাষণ।

সিনেমাটির শুরুতে দেখানো হয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক যুবক গ্রামবাংলার অপার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ। দেশের অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে সিনেমার গল্প শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক উত্তাল পরিবেশ দেখানো হয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর নতুন করে দেশ গড়ার স্বপ্ন দানা বাঁধে দেশের মানুষের মধ্যে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে ১১ জন মুক্তিকামী যুবকের একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার গল্পেই এগিয়েছে সিনেমা।

ওরা ১১ জন সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এর সংগীত। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন খোন্দকার নুরুল আলম। তিনটি গান রয়েছে সিনেমায়। আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা গানটি দিয়ে সিনেমায় বাংলার রূপ দেখানো হয়েছে। আমায় একটি খুদিরাম দাও বলে কাঁদিস না মা গানটি ব্যবহার করা হয়েছে যুদ্ধ চলাকালে এবং সিনেমার শেষ অংশে বেজে ওঠে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে গানটি। যুদ্ধজয়ের পর দেশের জন্য মানুষের যে ত্যাগ সে আবহ ফুটে ওঠে গানটি চিত্রায়ণের মাধ্যমে। চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হয় ত্যাগের নানা নমুনা।

১৯৭২ সালে সিনেমাটি নির্মাণে আনুমানিক লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। নিবেদনে ছিল জাগ্রত কথাচিত্র আর পরিবেশনায় স্টার ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটরস। সিনেমা মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই উঠে আসে নির্মাণ ব্যয়। সিনেমাটি ১৯৭২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। দেশে একাধিক স্বাধীনতার গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা হলেও এখনো ওরা ১১ জন সিনেমাটি পুরনো হয়ে যায়নি। সদ্য স্বাধীন দেশের বুকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমার ৫০ বছর পূর্তির পর এখনো চলচ্চিত্রটিকে মাস্টারপিস সিনেমা বলে আখ্যা দেয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন